প্রশাসনের শীর্ষ পদে কাজ করে আসা এই কর্মকর্তা বলেছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এমনকি মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের মতামতও উপেক্ষিত হয় বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়নে।
নতুন অর্থবছরের বাজেট নিয়ে শনিবার সিপিডির এক সংলাপে একথা বলেন আকবর আলি।
এই সংলাপে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত্ব করেন সিপিডি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ কোটি ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট সংসদে প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যা আগামী সপ্তাহে পাস হবে।
আকবর আলি বলেন, “আমাদের দেশে যেভাবে বাজেট তৈরি হচ্ছে, তাতে মন্ত্রী-এমপিদের কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি এ প্রক্রিয়ায় সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিরও কোনো ভূমিকা নেই।”
“নতুন কোনো করারোপ করা হলে তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয় না, বলেন সাবেক এই অর্থ সচিব।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দেন, আর অর্থমন্ত্রী সেভাবে একটা বাজেট তৈরি করেন। জনপ্রতিনিধিদের অংশ গ্রহণ না থাকায় বাজেট বাস্তবায়ন হয় না।”
বাংলাদেশের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থাকে। এবার প্রস্তাবিত বড় আকারের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তবে আকবর আলি বলেন, “আমি বড় বাজেটকে স্বাগত জানাই। কিন্তু বড় বাজেটের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন।”
অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি বলেন, “আগামী ৪/৫ বছর পর রিজার্ভেও ক্রাইসিস দেখা দিতে পারে। কারণ এখন যেভাবে বিদেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে, এটা পরিশোধের সময় রিজার্ভের উপর চাপ পড়তে পারে।”
সুশাসনের অভাবকেও দায়ী করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি।
ভ্যাটের সঙ্গে ব্যাংক হিসেবে আবগারি শুল্ক জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন তিনি।
“একদিকে ১৫ শতাংশ মূসক, অন্যদিকে ব্যাংক একাউন্টের উপরে আবগারি শুল্ক। এই দুটো কাজ একসঙ্গে করা একেবারেই ঠিক হয়নি।”
সরকারি ব্যাংকগুলো প্রতিবছর পুনঃঅর্থায়ন করে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয় বলে মত জানিয়ে এগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন সাবেক এই অর্থসচিব।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামাল বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার জন্য হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলাকে কারণ দেখান।
তিনি বলেন, “হলি আর্টিজানের দুর্ঘটনার কারণে প্রায় ১০ মাস মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ পিছিয়ে গেছে। ওই ঘটনা না ঘটলে মেগা প্রকল্পগুলোর অর্থছাড় অনেক টাকা ছাড় হত। তখন বাজেট বাস্তবায়নও বেশি হত।”
আগামী অর্থবছরে এসব প্রকল্পে প্রায় দুই বছরের বিনিয়োগ একসঙ্গে করতে হবে বলে এডিপির আকার বেড়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প বাস্তবায়ন ঠিক সময়ে শেষ করার জন্য কিছু সংস্কারের কথাও বলেন মন্ত্রী।
এখন থেকে জমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করেই প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
মুস্তফা কামাল বলেন, সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি না পাওয়ায় এখন থেকে আউটসোর্সিং করা হবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি রেহমান সোবহান কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আলাদা করে কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দেন।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এডিপি মানসম্পন্ন বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যয় ও সময় বেশি যাচ্ছে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ গ্রহণ করা। এ সুযোগ গ্রহণে সবার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে সবচেয়ে বেশি লাভ হত।
“যাদের জীবন মান উন্নয়ন করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব, সেখানে বিনিয়োগ করুন।”
দেশে দক্ষ জনশক্তি না থাকায় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে মানুষ এসে কাজ করে বছরে ৫ থেকে ৬০০ কোটি ডলার আয় করে নিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
“কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থ বরাদ্দ না দিয়ে রাজনৈতিক কারণে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এটাকে কীভাবে অগ্রাধিকার বলব? সারা বিশ্বে আপনারা দেখে থাকবেন ডিক্টেটররা (স্বৈরশাসকরা) মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর থাকে।”
মেগা প্রকল্পে সরকার অর্থ অপচয় করছে দাবি করে বিএনপি নেতা আমীর খসরু বলেন, “ফোর লেনের এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে ইউরোপে ২৮ কোটি টাকা ও চীনে মাত্র ১৩ কোটি টাকা লাগলেও আমাদের ৫৪ কোটি টাকা লাগছে। এটা অপচয়।”
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, “আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্যাক্তিখাতের যে অংশগ্রহণ থাকার কথা ছিল তা থাকছে না।”
প্রবৃদ্ধিকে তিনি দুই ইঞ্জিনের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, সরকারি বিনিয়োগের ইঞ্জিনটা চললেও বেসরকারি ইঞ্জিনটা চলছে না।
বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য বড় মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা না থাকাকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।