প্রবৃদ্ধি: বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্কলন ৭ শতাংশের নিচেই

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে সরকার আশা করলেও বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্কলন তার চেয়ে কম।

হুসাইন আহমদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2017, 03:20 AM
Updated : 5 June 2017, 10:46 AM

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রাক্কলন করা হলেও বিশ্ব ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচেই থাকবে।

বিশ্ব অর্থনীতির সম্ভাবনা নিয়ে সোমবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ঋণদাতা এ সংস্থার হালনাগাদ প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টসে’ চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনের আগের হার বহাল রাখা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের বাইরে চাহিদা বাড়ায় প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়ানোর কথা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেও বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে সরকারের হিসাবের চেয়ে বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্কলন ও পূর্বাভাসকেই নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবসম্মত বলে বিবেচনা করেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা। তারা বলছেন, রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহে মন্দা, বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও সাম্প্রতিক বন্যায় হাওরাঞ্চলের ফসলহানি বিবেচনা করলে প্রবৃদ্ধি আরও কম হওয়ার কথা।

কয়েকদিন আগে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন বাড়িয়ে ধরা হয়েছে বলে সংশয় প্রকাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানও বিবিএসের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বিশ্ব ব্যাংক প্রবৃদ্ধির হিসাব নির্ভরযোগ্য বলে মতপ্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক অর্থনীতির ধারাবাহিকতা যাচাই করে নির্দেশকগুলোর বাস্তব পরিস্থিতি ও প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক বাস্তবতার ভিত্তিতে একটা ‘ফিগার’ উপস্থাপন করে।

অন্যদিকে বিবিএস যে প্রক্রিয়ায় ও যে ধরণের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করছে তা পর্যাপ্ত ও বাস্তবভিত্তিক নয় বলে মনে করেন তিনি।

এর ব্যাখ্যায় কয়েকটি দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, বিবিএস প্রবৃদ্ধির হিসাব করেছে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের তথ্যের ভিত্তিতে; তাদের হিসাবে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহে সাম্প্রতিক ধাক্কাসহ অর্থনীতির ঝুঁকির বিষয়গুলো আমলে নেওয়া হয়নি; এবং ম্যানুফেকচারিং খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে ধরা হয়েছে, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম বলেন, “আমাদের প্রবৃদ্ধির বড় দুটি চালিকা শক্তি- রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহ- দুটোই বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি গতবছরের অর্ধেক হয়ে চার শতাংশে নেমেছে। রেমিটেন্সতো গত অর্থবছরের তুলনায় নেগেটিভ।

“দুটো চালিকা শক্তির যদি এরকম নাজুক অবস্থায় ওভারঅল প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় বাড়লে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ঠ অবকাশ থাকে। এটা আসলে কীভাবে সম্ভব?”

বিবিএসের হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবও তাই। কিন্তু এর পরের হিসাব আর মিলছে না।

চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ার পেছনে শিল্পখাতে (ম্যানুফেকচারিং) ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বড় ভূমিকার যে হিসাব বিবিএস দেখিয়েছে তাতেও সংশয় প্রকাশ করেন সেলিম রায়হান।

তিনি বলেন, “ম্যানুফেকচারিং খাতে গ্রোথ দেখানো হচ্ছে ১০ পার্সেন্টের মতো। এই জায়গাটায় একটা প্রশ্ন আছে- আমাদের ম্যানুফেকচারিং খাতের ৫০-৫৫ পার্সেন্ট রেডিমেট গার্মেন্টস। রেডিমেট গার্মেন্টেসের প্রবৃদ্ধি কিন্তু অনেক কম- ফোর পার্সেন্টের মতো- এবং এটা হান্ডে্রড পার্সেন্ট এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড।”

২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করে ২ হাজার ৮৭২ কোটি ডলার আয় করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। এই অঙ্ক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ কম।

তার আগের অর্থবছরে (১২ মাসে) পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৪২৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।

অধ্যাপক সেলিম বলেন, “এখন রেডিমেট গার্মেন্টেসের প্রবৃদ্ধি যদি গত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম হয় তাহলে ধরে নিতে হবে যে অন্য খাতগুলো অনেক ভাল করায় ওভারঅল ম্যানুফেকচারিংয়ে ১০ পার্সেন্ট গ্রোথ হয়েছে। কিন্তু আমরাতো দেখি না ‘নন-রেডিমেড গার্মেন্টস’ কোনো খাত খুব ভালো করেছে।

“এই হিসাবগুলোতোও মিলছে না, এগুলোতো মিলতে হবে।”

বিবিএস সারা বছরের উপাত্ত নিয়ে প্রবৃদ্ধির হিসাব সংশোধন করবে বলে আশা প্রকাশ করে সেলিম বলেন, সামগ্রিক তথ্যের ভিত্তিতে ‘রিভাইজ’ করলে দেখা যাবে তাদের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনও বিশ্বব্যাংকের মতো বা তার কাছাকাছি হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) কয়েক দিন আগেই সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, হাওরে সাম্প্রতিক ফসলহানি, রপ্তানি ও রেমিটেন্সে মন্দা এবং বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিবেচনা করলে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে কম হওয়ার কথা।

বিশ্ব ব্যাংক বলছে, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেও চলতি বছর বাংলাদেশ ভালো প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে কৃষি ও সেবা খাত চাঙ্গা থাকার কারণে। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও শিল্প উৎপাদনের পরিস্থিতিও ভালো।

“তেলের দামে স্থিতিশীলতা ও রপ্তানিতে সামান্য হলেও প্রবৃদ্ধি থাকায় বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি আরও কমেছে। উপযোগী আবহাওয়া ও তেলের দাম কমার কারণে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার নিচে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।”

(ফাইল ছবি)

তবে রেমিটেন্স প্রবাহে মন্দা থাকায় কিছুটা উদ্বেগ থাকছেই। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ি এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর মন্দা ঝুঁকি তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্স প্রবাহের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা মোট এক হাজার ১৫৫ কোটি ৪৮ লাখ (১১.৫৫ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

তার আগের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে দেশে এসেছিল ১ হাজার ৩৪৬ কোটি ৫২ লাখ ( ১৩.৪৬ বিলিয়ন) ডলার। সে হিসাবে এই ১১ মাসে প্রবাসী আয় কমেছে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।

আগামীতে প্রবাসী আয়ের প্রবাহে বড় ধরনের ধস দেখা দিলে বাংলাদেশের সামষ্টিক ভোগ ও বিনিয়োগেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব ব্যাংক।   

আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৬ দশমিক ৪ শতাংশে নামতে পারে বলে বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে। সেই সঙ্গে ২০১৮-২০২০ সময়ে গড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলেও ধারণা দেওয়া হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাঙ্গা হলে রেমিটেন্স বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের আস্থা ও বিনিয়োগ বাড়বে বলে বিশ্ব ব্যাংকের ধারণা।

তবে বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল, পাকিস্তান ও ভারতে নির্বাচন সামনে রেখে নীতিগত ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ও নির্বাচনের ফল অর্থ বাজারকে অস্থির করে তুলতে পারে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।

২০১৭ সালে সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস।