এই অংক বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১১ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস অগাস্টে ১১৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন তারা। বাকি ১০ মাসের তিন মাস ১০০ কোটি ডলারের কম এসেছে। সাত মাস এসেছে ১০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা।
তিনি রোববার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে।
“ঈদ সামনে রেখে এখন আরও বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। সে কারণে জুন মাসেও রেমিটেন্স বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকবে।”
গত এপ্রিলে আগের মাসের তুলনায় কিছু বাড়লেও অর্থবছরের ১০ মাসের হিসাবে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো কমে ১৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণ রেমিটেন্সের এই নিম্নমুখী প্রবণতায় উদ্বিগ্ন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও। প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠাতে চার্জ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
এই ঘোষণা কার্যকর হলে রেমিটেন্স আরও বাড়বে বলে মনে করছেন শুভঙ্কর সাহা।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্স প্রবাহের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা মোট এক হাজার ১৫৫ কোটি ৪৮ লাখ (১১.৫৫ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
তার আগের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে দেশে এসেছিল ১ হাজার ৩৪৬ কোটি ৫২ লাখ ( ১৩.৪৬ বিলিয়ন) ডলার। সে হিসাবে এই ১১ মাসে প্রবাসী আয় কমেছে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
আর ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রেমিটেন্স কমেছিল ১৬ শতাংশ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এপ্রিল মাসে রেমিটেন্স এসেছিল ১০৯ কোটি ২৬ লাখ ডলার। মার্চ মাসে আসে ১০৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।
তার আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ৯৪ কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছিল, যা ছিল একক মাসের হিসাবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতেও বিশ্বব্যাপী রেমিটেন্স কমার কথা বলা হয়েছে।
এটি মাথায় রেখে রেমিটেন্স বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত।
তিনি সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পৃথিবীর সব দেশেই রেমিটেন্স কমছে। আমরাও তা থেকে বিচ্ছিন্ন নই।
“রেমিটেন্স ছাড়া আমাদের অর্থনীতির সব সূচকই ভালো। রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। রেমিটেন্স বাড়ানোই এখন আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।”
বাংলাদেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স।
রেমিটেন্স প্রবাহ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি তারা এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। পরিস্থিতি বুঝতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া ঘুরে এসেছে।
কেন কমছিল রেমিটেন্স?
রেমিটেন্স কমার কারণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার কথা বলছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেই সঙ্গে টাকার দরপতন ও হুন্ডিকেও দায়ী করেন তিনি।
মুহিত সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সেসব দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তেলের দামও সেভাবে বাড়েনি, ফলে তাদের বাজেট ঘাটতি রয়েছে।
“এ কারণে সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। অনেকের বেতনও কমে গেছে; চাকরি হারিয়েছে কেউ কেউ। এ কারণে আমাদের প্রবাসী আয় কমে গেছে।”
রেমিটেন্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিদেশ থেকে অবৈধ পথে টাকা পাঠানোকে দায়ী করছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি।
তিনি সম্প্রতি সংসদে বলেন, “অনেকে বেশি লাভের আশায় হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়, যে কারণে রেমিটেন্স কমেছে। বর্তমানে হুন্ডির ব্যবসা জমজমাট রূপ নিয়েছে।”
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের অর্থনীতির নাজুক অবস্থার কথা বলে আসছে আইএমএফ। সেখানে গিয়ে অনেকের বেকার পড়ে থাকার খবরও আসছে।
বাংলাদেশের রেমিটেন্সের অর্ধেকের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত রেমিটেন্স কমার জন্য টাকার দরপতনকে দায়ী করেন।
“ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, মালয়েশিয়ান রিংগিত ও সিঙ্গাপুরি ডলারের মূল্যমান সাম্প্রতিক সময়ে কমে গেছে। ফলে এসব দেশের শ্রমিকদের আয়ের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা কম পাওয়া যাচ্ছে।”
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরে প্রবাসী আয় মাসে ১০০ কোটি ডলারের বেশি থাকলেও গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তা নেমে আসে যথাক্রমে ৯৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার ও ৯৫ কোটি ৮৭ লাখ ডলারে। এরপর জানুয়ারিতে ১০১ কোটি ডলার দেশে আসে।
প্রবাসী আয়ের নেতিবাচক প্রবণতা প্রথম দেখা দেয় ২০১৩ সালে। ওই বছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ৩৮৩ কোটি ডলার পাঠান, যা ২০১২ সালের তুলনায় ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ কম ছিল।
এরপর ২০১৪ সালে প্রবাসী আয়ে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। তবে ২০১৬ সালে তা আবার ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ কমে যায়।