ব্যাংকে যাদের লাখ টাকা, তারা সম্পদশালী বলেই বাড়তি কর: অর্থমন্ত্রী

ব্যাংকে যাদের এক লাখ টাকা রাখার সামর্থ্য আছে তারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘সম্পদশালী বলেই’ বাজেটে তাদের উপর বাড়তি কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2017, 10:51 AM
Updated : 2 June 2017, 07:20 PM

জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপনের পরদিন শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ কথা বলেন তিনি।

অর্থমন্ত্রী বলেন, “যারা একলাখ টাকা ব্যাংকে রাখতে পারেন, তারা আমাদের দেশের তুলনায় সম্পদশালী। তারা বাড়তি ভারটা বহন করতে পারবেন, সমস্যা হবে না।”

বছরের যে কোনো সময় ব্যাংক হিসেবে এক লাখ টাকার বেশি লেনদেনে আবগারি শুল্ক বিদ্যমান ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।

তবে শুল্কমুক্তসীমা ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে বছরের যে কোনো সময় ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেনে শুল্ক দিতে হতো না, এখন ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হবে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, ২০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনে যে ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক ছিল নতুন বাজেটে তা মওকুফ করা হয়েছে।

আবগারি শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবে বলে যে সমালোচনা রয়েছে তা সংবাদ সম্মেলনে নাকচ করে দেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “যাদের টাকা এক লাখের উপরে থাকবে কেবল তাদের উপরই একটা কর ধার্য্য করেছি। বড়লোকের ক্ষেত্রে আমাদের করটা ছিল, কিন্তু যারা মিড লেভেলে ছিল তারা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। একলাখ টাকার নিচে যারা আছেন, তাদের ভার থেকে মুক্ত করাই যথেষ্ট।”

নতুন বাজেটে বছরের যে কোনো সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনে আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ টাকার বদলে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০ টাকার বদলে ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেনে ১৫ হাজার টাকার বদলে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

তবে বৃহস্পতিবার বাজেট বক্তৃতার পর ব্যাংক লেনদেনে আবগারি শুল্ক আরোপের ভিন্ন হার উল্লেখ করে এনবিআর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করলে সংশয়ের সৃষ্টি হয়।

সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত শুল্ক হারই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

১৫ শতাংশ ভ্যাটেও দাম বাড়বে না

নতুন অর্থবছরে বাজেটের খরচ মেটাতে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে কর ও শুল্ক হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা আসবে মূল্য সংযোজন কর থেকে।

জুলাইয়ের শুরু থেকে সবক্ষেত্রে অভিন্ন হারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হলেও বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না বলে দাবি করেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ছোট ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনা করে ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লাখ টাকা করা হয়েছে। টার্নওভার করের সীমা ৮০ লাখ টাকা থেকে দেড় কোটি টাকা করা হয়েছে।

“তার মানে আগে যারা ভ্যাট দিতেন তাদের অনেকেই ভ্যাট দেবেন না, ৩০ থেকে ৩৬ লাখ হওয়ার ফলে। আগে যারা বিভিন্ন হারে ভ্যাট দিতেন, ৮০ লাখের উপরে যারা ছিলেন তারা এখন ৪ শতাংশ ট্যাক্স দেবেন।

এছাড়া অনেক পণ্যে ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে জানিয়ে মুহিত বলেন, “এই কারণে আমি বলেছি দাম বাড়বে না। যারা ক্ষুদ্র ও মধ্যম সারির ব্যবসায়ী, তারা এর মধ্যে পড়ে যাবে।”

 

বৃহস্পতিবার সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় বিদ্যমান ৫৩৬টি পণ্য ও সেবার সংখ্যা বাড়িয়ে প্রায় ১ হাজার ৪৩টি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।

এর মধ্যে চাল, ডাল, মুড়ি, চিড়া, চিনি ও আঁখের গুড়, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, তরল দুধ, প্রাকৃতিক মধু, বার্লি, ভুট্টা, গম ও ভুট্টার তৈরি সুজি, লবণসহ প্রায় ৫৪৯টি মৌলিক খাদ্যপণ্য রয়েছে।

এছাড়া ৯৩ ধরনের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং গণ-পরিবহন সেবা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এর সঙ্গে কৃষি, গবাদি পশু ও মৎস্য চাষ খাত সংশ্লিষ্ট প্রায় ৪০৪টি ক্ষেত্রে এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত ব্যবস্থার ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বিদ্যমান মূল্য কিছুটা হ্রাস পাবে এবং কোনো অবস্থাতেই কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে না।

সরকারের দক্ষতা বেড়েছে

অর্থমন্ত্রী ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেটে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছেন। তাতে আয়-ব্যয়ে ঘাটতি থাকছে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা বিদেশি উৎস থেকে পাওয়ার আশা করেছেন মুহিত।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ বিদেশি অর্থায়ন ব্যবহারের পরিমাণ যেখানে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যবহারের পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত বা অর্জনযোগ্য কি না- সেই প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি। 

এ বিষয়ে এক প্রশ্নে মুহিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এবারের বাজেটে বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ বিদায়ী বাজেটের চেয়ে বেশি ধরা হয়েছে, পাইলাইনেও অনেক টাকা আছে। এই টাকার সদ্ব্যবহার করতে পারছি না। টোটাল টাকা ব্যবহার করতে পারছি না।

“কিন্তু এরপরও বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ বেশি রেখেছি। কারণ এর মধ্য দিয়েই এই টাকা ব্যবহারের সক্ষমতা আমরা অর্জন করব।”

বাজেট বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারছে না- এমন সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে মুহিত বলেন, “বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। কে বলেছে আমাদের দক্ষতা বাড়েনি। আমি বলছি আমাদের দক্ষতা অনেক বেড়েছে। আর তা যদি না হয়, তাহলে আট বছর আগে যেখানে ৯১ হাজার কোটি টাকা বাস্তবায়ন করেছি বিদায়ী অর্থবছরে সেখানে ৩ কোটি ১৮ লাখ কোটি টাকা করছি।”

 

‘বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে’

দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে দাবি করে অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশই আসছে বেসরকারি খাত থেকে।

“রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত বিনিয়োগে খারাপ অবস্থা ছিল। সেটা ২০১৫ সাল থেকে কেটে গেছে। এখন দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে, ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। তার সুফল আগামী বছর ব্যাপকভাবে প্রতিভাত হবে।”

অভাবে কারণে ভিক্ষুক ‘বেশি নয়’

দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা খুবই কম দাবি করে মুহিত বলেন, “আমি ভিক্ষাবৃত্তি সম্বন্ধে এই বাজেটে একটা রেফারেন্স দিয়েছি, অতি সামান্য অবশ্যি। ভিক্ষুকের সংখ্যা খুব কম দেশে। কিন্তু কিছু লোক আছে, তাদের বৃত্তিটাই হচ্ছে ভিক্ষা। কোনোদিনই পরিবর্তন করা যাবে না। এটা চলতেই থাকবে।

“এই যে একটা রিয়েল ফ্যাক্ট অব লাইফ ভিক্ষুক থাকবে। কিন্তু যারা অভাবের টানে ভিক্ষুক তারা এত বেশি নয়।”

তেল- গ্যাস-বিদ্যুৎ

এক প্রশ্নের উত্তরে মুহিত বলেন, “গ্যাসের দাম যা ছিল তাই রয়েছে। বাজেটে আমি বলেছি, গ্যাসের দাম ২০১৮ সালে বাড়বে; যখন গ্যাস আমদানি হবে তখন। আগামী বছরে গ্যাস আমদানি হলে গ্যাসের দাম বাড়বে। তেলের দাম কমাইনি এটা ঠিক না। বলতে পারেন যতটা কমানো উচিত ছিল ততটা কমাইনি।”

এত বিদুৎ উৎপাদনের পরও দেশে লোডশেডিং কেন হচ্ছে, তথ্যে কি গরমিল আছে কি না জানতে চাইলে মুহিত বলেন, “লোডশেডিং দেশে খুব কম আছে। লোডশেডিংয়ের শঙ্কা একেবাবেই অমুলক।”

মালভূমি তত্ত্ব

অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের’।

চার লাখ কোটি টাকার এই বাজেটকে কেউ কেউ ‘উচ্চাভিলাষী’ বলায় তার জবাবে মুহিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমার এই বাজেট উচ্চাভিলাষী বাজেট। প্রত্যেকটা বাজেট উচ্চাভিলাষী। আমার কোনো বাজেট তার আগের বাজেটের থেকে কম হয়েছে? বাজেট মানেই উচ্চভিলাষী। বাজেট মানেই উচ্চতর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা এবং সেটা আমরা সার্থকভাবে করেছি।

“দেশটা এখন উন্নয়নের একটা মালভূমিতে আছে। আগে যেখানে আমার অবস্থান ছিল সেই মালভূমি থেকে বেরিয়ে তার পরবর্তী মালভূমি পেরিয়ে, তার পরবর্তী অবস্থায় এখন আছি। এবং এটা উচ্চাভিলাষের ফসল।”

ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি ‘সব দেশে হয়’

সরকারি ব্যাংকের পর দেশের বেসরকারি ব্যাংকেও অনিয়ম শুরু হয়েছে- এক সাংবাদিকের এমন মন্তব্যের জবাবে মুহিত বলেন, “ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি হয়, চুরি-চামারি হয়, সব সময় কিছু না কিছু হয়, সব দেশেই কিছু না কিছু হয়। সেটা হয়ত কোনোখানে একটু বেশি হয়। আমাদের দেশে বেশিভাবে চলছিল, সেটা আমরা দমাতে চেষ্টা করছি।

“আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে লুটপাট হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। দুই একটা ব্যাংকে কিছু সমস্যা আছে এবং সে সমস্যাগুলোর সমাধানের উপায় দেখছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে অবদান রাখছে।”

 

‘শ্রেষ্ঠ বাজেট’

এক সাংবাদিক অর্থমন্ত্রীকে তার নিজের দেওয়া বাজেটের ভালো-মন্দ দিক মূল্যায়ন করতে বললে মৃদু হেসে মুহিত বলেন, “আমি মনে করি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট আমি দিয়েছি। আর এই দেওয়ার জন্য যে প্রয়োজন সেই কষ্টও করেছি; আমার সঙ্গে কষ্ট করেছে আমার সমস্ত প্রশাসন। আর মন্দ কিছু তো আমি দেখছি না।”

তার দাবি, এই বাজেটের সব জায়গাই ‘উজ্জ্বল’। কোথাও কোনো ‘দুর্বলতা নেই’।

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন ও ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আজম এবং পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. জিয়াউল ইসলামও এসময় উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম ছাড়াও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।