পরিকল্পনামন্ত্রীর মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন

প্রথা ভেঙে প্রতি মাসের পরিবর্তে যে পদ্ধতিতে তিন মাসের মূল্যস্ফীতির গড় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রকাশ করেছেন তা ‘সঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন দুজন অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।

জাফর আহমেদ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2017, 05:05 PM
Updated : 16 May 2017, 06:12 PM

তারা বলছেন, নিয়মিত প্রকাশ না করে সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্য আটকে রাখায় অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা তৈরি হতে পারে।

মঙ্গলবার শেরে বাংলা নগরে সংবাদ সম্মেলন করে প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির তথ্য তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

সেখানে দেখানো হয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) যেখানে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ, সেখানে এবার একই সময়ে তা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।

পরে সাংবাদিকরা তার কার্যালয়ে গিয়ে কোন পদ্ধতিতে এই মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তৈরি করা মূল্যস্ফীতির মাসিক তথ্য সরবরাহ করেন।

বিবিএসের এই তথ্যে দেখা যায়, এবছর জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে তা হয় ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং মার্চে গিয়ে তা বেড়ে হয় ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

আগের বছরের প্রথম তিন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ, ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

অর্থাৎ, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এবার একই সময়ে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হার কম। তবে চলতি বছরের তিন মাসে ক্রমাগতভাবে সেই হার বাড়ছে।

হিসাব করে দেখা যায়, পরিকল্পনামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তথ্য আসলে তিন মাসের মূল্যস্ফীতির হার যোগ করে গড় হিসেবে পাওয়া অংক {(৫.১৫+৫.৩১+৫.৩৯)/৩=৫.২৮}।

এভাবে হিসাব করে চলতি বছরে প্রথম প্রান্তিকের হার আগের প্রান্তিকের তুলনায় কম দেখানোর ফলে মাসের হিসেবে মূল্যস্ফীতির ক্রমাগত বৃদ্ধির প্রবণতা আড়ালে থেকে গেছে।

এই পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাবের সমালোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এমএ তসলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূল্যস্ফীতি হিসাব করার ক্ষেত্রে এই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা কোনোভাবেই সঠিক নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই এভাবে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয় না।”

তিনি বলেন, এভাবে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার প্রকাশ করা হলে গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যের ক্ষেত্রে ৫ মাস পিছিয়ে থাকতে হবে। যেমন মে মাসে এসে সবাই জানতে পারছে জানুয়ারি মাসে কত ছিল।

“এ সিদ্ধান্ত আমাদেরকে এভাবে পিছিয়ে নিয়ে যাবে।”

অর্থনীতিবিদ তসলিম বলেন, সাধারণত ব্যবসায়ীরা মূল্যস্ফীতির হার দেখে তাদের পণ্যের দাম সমন্বয় করেন। পাঁচ মাস পরে মূল্যস্ফীতির তথ্য পেলে তাদের ব্যবসায় সমস্যা হতে পারে।

তিন মাসে একবার মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের কারণ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সন্দেহ আরও গুরুতর।

“বছরের প্রথম দুই মাসে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা দেখে ডেটা আটকানোর কৌশল হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী এমনটি করছেন বলে আমার মনে হয়।”

তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ ডেটা অনলাইনে দিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে যার দরকার সে ওই তথ্য নিয়ে গবেষণা, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বা মুদ্রানীতি তৈরিতে ব্যবহার করে।

“মূল্যস্ফীতির ডেটা অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নির্দেশক। ডেটাকে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। নির্ভেজাল ডেটা দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় নির্দেশক।”

মূল্যস্ফীতির তথ্য অন্য কোনো দেশে কখনো মন্ত্রীরা প্রকাশ করেন না বলে মন্তব্য করেন এই গবেষক।

তিনি বলেন, “পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। তাদের কাজে কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। এরকম কর্মকাণ্ড সরকারকে দুর্বল করবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনাস্থা তৈরি করবে।”