হার্ভার্ডে আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা

বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে এক সেমিনারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভূয়সি প্রশংসা করেছেন আলোচকরা।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2017, 07:09 AM
Updated : 13 May 2017, 09:29 AM

বিশ্ব মন্দার মধ্যেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে ধরে রাখার প্রশংসা করে বস্টন ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্টের প্রেসিডেন্ট গুস্তফ প্যাপানেক বলেছেন, যেখানে বিশ্বের অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি কমেছে, সেখানে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে ৬ ভাগের উপরে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। দারিদ্র্য ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে।

“২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা বিশ্বের অনেক দেশের পক্ষেই সম্ভব হয়নি,” বলেন বস্টন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির এই এমিরেটাস অধ্যাপক।

শ্যান্টাল-লিন কার্পেন্টিয়ার

বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা দেখে আরও অগ্রগতির লক্ষণ দেখছেন নিউ ইয়র্কে আঙ্কটাড অফিসের ইউএন কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান কর্মকর্তা ড. শ্যান্টাল-লিন কার্পেন্টিয়ার।

“এমডিজির মতো বাংলাদেশ এসডিজি অর্জনেও সক্ষম হবে। বিশেষ করে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবেই।”

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে শুক্রবার ‘উদ্যোক্তা সৃষ্টি, বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন’ শীর্ষক দুদিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী দিনে ওই সেমিনারে বক্তব্য রাখেন তারা।

হার্ভার্ডের ‘কর্পোরেট সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড হেলথ’র সহায়তায় ‘ইন্টারন্যাশনাল সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট’র উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির ল’ স্কুল মিলনায়তনে এই সেমিনার হয়।

আইএসডিআইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল ইউসুফ বলেন, “বাংলাদেশ নিয়ে এতদিন যারা শুধু নেতিবাচক মতামত ব্যক্ত করতেন, এখন তাদের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে ইতিবাচক মতামত।”

ইকবাল ইউসুফ

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, এমআইটিসহ যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণারত শিক্ষক ছাড়াও জাতি সংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা এবং তা অর্জনে নানা চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করেন বক্তারা।

গ্রামীণফোনের অন্যতম উদ্যোক্তা এমআইটির লেগাটাম সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অন্ট্রাপ্রিনিয়ারশিপের নির্বাহী পরিচালক ইকবাল কাদির বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় মোবাইল ফোনের ভূমিকা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। টেলিকমিউনিকেশন খাতে প্রথম বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ১৯৯৬ এর সরকারের সময়, যা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত।”

অধ্যাপক প্যাপানেক বলেন, বাংলাদেশের মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে বার্ষিক ৩০ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি বার্ষিক কমপক্ষে ১০ লাখ শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত করা সহজ হবে।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির লেবার অ্যান্ড ওয়ার্কলাইফ কর্মসূচির গবেষণা পরিচালক ড. জন ট্রাম্পবোর বাংলাদেশের শ্রমিকদের কল্যাণে নেওয়া বিভিন্ন কাজের প্রশংসা করে এক্ষেত্রে আরও পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন।

বিডা চেয়ারম্যানসহ আলোচকরা

সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনও বক্তব্য রাখেন।

বিডা চেয়ারম্যান কাজী আমিন বিনিয়োগ টানার লক্ষ্যে নানা সংস্কার কর্মসূচির কথা তুলে ধরেন। 

তিনি বলেন, “কল-কারখানা অথবা বৃহৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজের অনুমতির জন্যে আগে গড়ে ২৬৯ দিন অপেক্ষা করতে হত, এখন লাগে মাত্র ৬০ দিন। বিদ্যুৎ সেক্টরেও অনুমতির জন্যে অপেক্ষার সময় ৪০৪ দিন থেকে কমিয়ে ২৮ দিনে আনতে সক্ষম হয়েছি। বিনিয়োগে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালুর একটি আইন হচ্ছে।

“এ দপ্তরে (বিডা) আমার বয়স মাত্র ৭ মাস। এরইমধ্যে আমি প্রচণ্ড আশাবাদী যে, বাংলাদেশ যে সব কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তা আটকে থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গোটা প্রশাসন এবং সমগ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে।”

মসিউর রহমান

মসিউর রহমান সেমিনারে উপস্থিত ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।

তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের জন্য সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, “গত ৮ বছরে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে কমপক্ষে তিনবার। বাজার দরের সাথে সঙ্গতি রেখে শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির এমন নজির উন্নয়নশীল বিশ্বে খুব কমই দেখা যায়।”

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক উপ-প্রধান ডেভিড মেলে এবং ইউএনসিডিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুথ গুডউইন গ্রোয়েন বলেন, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকারের কাজের প্রশংসা করেন।

গ্রোয়েন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পেরও প্রশংসা করেন।

আবুল কালাম আজাদ ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনার কথা সবাইকে জানান।

রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়নে এই সেমিনার অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশসমূহে অর্থায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা দূর করতে জাতিসংঘসহ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা প্রয়োজন।”

সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন।

হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের ইলিন ম্যাকনিল ও র‌্যামন আলবার্টো, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা টম লারস্টেন, এমআইটির রবার্ট স্টনার, ম্যাসেচুসেটসের গৃহায়ন এবং ইকনোমিক ডেভেলপমন্ট বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ন্যাম ফ্যাম, জাতিসংঘে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য সম্পর্কিত কর্মকর্তা সোনিয়া বালসাজার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

সামিট গ্রুপের প্রধান আজিজ খান, আইএসডিআইর আবু হাসনাত, অনির চৌধুরী, কবির বিন আনোয়ার, টেকনোহ্যাভেনের হাবিবুল্লাহ এন করিম, আনিস খান, ব্র্যান্ডেল ইউনিভার্সিটির সাজেদ কামাল, গ্রিনপিসের আশীষ ফার্নান্দেজও আলোচনা করেন।

গত ৬ বছর ধরে এই সম্মেলন হয়ে আসছে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে, এবারের আয়োজনে দু’শতাধিক ব্যক্তি অংশ নেন।