প্রধানমন্ত্রীর বক্তব‌্যের প্রতিবাদ ইউনূস সেন্টারের

পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব‌্যাংকের অর্থায়ন আটকাতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা ও তার নামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর না দেওয়ার বিষয়ে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব‌্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউনূস সেন্টার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2017, 06:54 AM
Updated : 29 Jan 2017, 12:25 PM

ইউনূস সেন্টারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই দীর্ঘ প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে ‘বেশ কিছু ভুল ও অসত্য মন্তব্য’ করেছেন।

“এসব অভিযোগের অনেকগুলোই এর আগেও একাধিকবার করা হয়েছে এবং প্রতিবারই ইউনূস সেন্টার এর জবাব দিয়েছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি অভিযোগের জবাব আবারও তুলে ধরছি। ২০১১ সাল থেকেই এই অভিযোগগুলোর অধিকাংশই বার বার তোলা হচ্ছে এবং প্রতিবারই এসব অভিযোগের পূর্ণ জবাব আমরা দিয়েছি।”

নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থ এক তহবিল থেকে অন্যটিতে সরানোর অভিযোগ ওঠার পর ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আইনি লড়াইয়ে গেলেও তাতে হেরে যান ইউনূস।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫ জানুয়ারী সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব‌্যাংকের অর্থায়ন আটকাতে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ইউনূসের যোগসাজশকে দায়ী করেন।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশের কোন এক স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদক আর উনি (ইউনূস) মিলে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে… আমেরিকার ফরেন সেক্রেটারি হিলারি ক্লিনটনসহ এদের সকলের লবিংয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের টাকা দেওয়াটা বন্ধ করে দেওয়া হল।”

দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন আটকে দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক। পরে বিশ্ব সংস্থাটিকে বাদ দিয়ে নিজেদের অর্থেই এই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।

গ্রামীণ ব্যাংকের পদ থেকে সরানোয় ক্ষিপ্ত হয়ে নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন ঠেকাতে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন বলে আগে থেকেই বলে আসছেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, “আমরা কিন্তু উনাকে (ইউনূস) সরাইনি। তিনি মামলায় হেরে গেছেন।... মামলা করার পরামর্শদাতা ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তার মেয়ে। উনি মামলায় হারলেন। আইনের কারণে উনার এমডি পদ চলে গেল। এরপর উনি আমাদের ওপর ক্ষেপে গেলেন। সেই ক্ষ্যাপাটা পড়ল আমার পদ্মা সেতুর উপর।”

এর প্রতিবাদে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতিতে বলা হয়, “ইউনূস পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহারে প্রভাব খাটিয়েছিলেন - এই অভিযোগ প্রফেসর ইউনূস অতীতেও সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এবার এই কাহিনীটি ভিন্নভাবে উপস্থাপন করলেন। এবারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন যে, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রত্যাহার করতে প্রফেসর ইউনূস একটি পত্রিকার সম্পাদকসহ বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। কাহিনীটি যেভাবেই বলা হোক না কেন, প্রফেসর ইউনূস এই কাহিনী বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন।”

ইউনূসের জন্য হিলারির ফোন পাওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী সেদিন সংসদে বলেন, “তার লবিস্ট আছে, এ আছে সে আছে। অনেক টাকা পয়সা খরচা... অনেক বড় বড় জায়গা থেকে টেলিফোন, আর অনুরোধ।

“আমেরিকার হিলারি ক্লিনটন আমাকে ফোন দিলেন, তাকে এমডি পদ থেকে কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে। আমি বললাম, বাদ তো আমরা দিচ্ছি না। উনি মামলা করেছেন, মামলায় হেরে গেছেন। এখানে আমাদের তো কিছু করার নেই।

“কোর্ট যে উনার থেকে অতিরিক্ত ১০ বছরের জন্য টাকা ফেরত চায়নি এটা বড় কথা,” বলেন শেখ হাসিনা।

ইউনূসকে অপসারণের কারণ ব‌্যাখ‌্যা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আইন অনুযায়ী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এমডি থাকা যায়। কিন্তু ইউনূস ৭০ পার করেও তা চালিয়ে গেছেন। ইউনূসের প্রতি সবার ‘দুর্বলতা ছিল’ বলেই তিনি যেভাবে চালান সেইভাবেই গ্রামীণ ব্যাংক চলছিল।

“আইনের কারণে তিনি এমডির পদ হারালেন, কিন্তু এর সম্পূর্ণ দোষ পড়ল আমার উপর। এখানে আমার কিছুই করার ছিল না।”

এ বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতিতে বলা হয়, “২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত শাসনামলে ইউনূসের বয়স ৬০ বছর পার হলেও সরকার কখনোই বয়সের প্রসঙ্গটি তোলেনি। গ্রামীণ ব্যাংকের আইনেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অবসরের বয়সসীমা সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের প্রতিবেদনে অবসরের বয়সসীমা নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু ২০১১ সালে প্রসঙ্গটি তোলা হয়।”

সংসদের প্রশ্নোত্তরে গ্রামীণফোন নিয়ে কথা বলার সময় সেদিন নোবেলজয়ী ইউনূসকে ‘চিটিংবাজ’ আখ্যায়িত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “অত্যন্ত দুঃখের বিষয় গ্রামীণফোনের যে শেয়ার বাংলাদেশের থাকার কথা, তার অধিকাংশ তিনি বিদেশে দিয়ে ওটাকে সম্পূর্ণ নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে নিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকে গ্রামীণফোনের কোনো লভ্যাংশ যায়নি। এটা চিটিংবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। রীতিমতো ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। এখন ওটা উনার নিজস্ব সম্পত্তি। এখন এটার ৩০ ভাগ মালিকানা নিজের হাতে রেখে বাকিটা উনি বেচে দিয়েছেন।”

এর প্রতিবাদ বানিয়ে ইউনূস সেন্টার বলেছে, “সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এজেন্সিতে রক্ষিত এ সংক্রান্ত সকল দলিল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি বক্তব্যই ভুল। গ্রামীণ ফোনের জন্ম হয়েছিল একটি দীর্ঘ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এ সংক্রান্ত কোনো দলিলই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করবে না।”

ইউনূস সেন্টার বলছে, গ্রামীণ ফোন প্রতিষ্ঠার কোনো পর্যায়েই এ কোম্পানিতে ইউনূসের কোনো শেয়ার ছিল না এবং এখনো শেয়ার নেই। একইভাবে গ্রামীণ ফোনে গ্রামীণ ব্যাংকেরও কোনো শেয়ার ছিল না, তাই শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার কোনো প্রশ্ন আসে না। কেবল গ্রামীণ টেলিকম সকল পার্টনার ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী জনগণের কাছে ছাড়ার জন্য কিছু শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে।

ইউনূস মামলা করে তার স্থায়ী আমানতের কর দিচ্ছেন না জানিয়ে শেখ হাসিনা সেদিন সংসদে বলেন, “তার টাকা আছে প্রচুর। ট্যাক্স দেন না। মামলা করে রেখে দিয়েছেন। ট্যাক্স না দিয়ে ভালোই চলছেন।”

এর প্রতিক্রিয়ায় ইউনূস সেন্টার বলেছে, “কর এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রফেসর ইউনূস বরাবরই তার কর পুরোপুরি ও সময়মতো পরিশোধ করে আসছেন। তিনি প্রতি বছর বেশ বড় অংকের টাকা কর দিয়ে থাকেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে জাতিকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস কখনোই কোনো অজুহাতে তার উপর ধার্য ন্যায্য কর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি।

“তার কর সংক্রান্ত ফাইলগুলোতে ভুল খুঁজে বের করতে সেগুলো বার বার তদন্ত করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই ফাইলগুলো নিষ্কণ্টক পাওয়া গেছে। পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, তার ও তার স্ত্রীর সাথে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জমা দিতে দেশের সকল ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর তথ্য থেকে নতুন কিছু বেরিয়ে আসেনি।”

বিবৃতিতে বলা হয়, ইউনূসের আয়ের উৎস তিনটি। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সম্মেলনে বক্তৃতার জন্য সম্মানী, বইয়ের রয়্যালটি এবং এ দুই উৎস থেকে পাওয়া অর্থ মেয়াদী আমানতে জমা রেখে তা থেকে প্রাপ্ত আয়। প্রতিটি উৎস থেকে অর্থপ্রাপ্তির তথ্যও কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত জানানো হয়। ফলে তার আয়ের সূত্র সম্পর্কে না জানার কোনো কারণ নেই।

“এটা বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ তথ্য দেয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এ নিয়ে বার বার উদ্বেগ প্রকাশের পরও তারা যদি এ সংক্রান্ত যথাযথ তথ্য প্রদান না করেন, এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে দাঁড়িয়ে জাতির কাছে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেন, তার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংক সুদমুক্ত; এটা সত্য। কিন্তু তার পাশাপাশি ৪০-৫০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো তো সুদমুক্ত নয়। সেইগুলোর ট্যাক্স কেন সরকারকে দেবে না? সেই রিপোর্টও এনবিআরের কাছে আছে।”

এ অভিযোগও ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করা হয়েছে ইউনূস সেন্টারের প্রতিবাদলিপিতে।

এনবিআরের সঙ্গে ইউনূসের মামলা লড়া প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এটা সত্য যে, কর অফিস কর্তৃক কিছু কর দাবি সম্পর্কে তিনি আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রফেসর ইউনূসকে আইনের আশ্রয় নিতে হয়েছে কেননা কর আইনের একটি দীর্ঘদিন ধরে অনুসৃত ব্যাখ্যা থেকে কর কর্তৃপক্ষের আকস্মিকভাবে সরে আসার কারণে তার ইতোপূর্বে জমাকৃত সকল ট্যাক্স রিটার্নের উপর এর প্রভাব পড়ে এবং এর ফলে তাকে আকস্মিকভাবে একটি বড় অংকের বকেয়া করের মুখোমুখি হতে হয়। প্রফেসর ইউনূস এ বিষয়ে সুবিচারের জন্য আদালতে গেছেন।”

ইউনূস সেন্টার বলছে, প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘একজন সুদখোর’ বললেও গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে সরকারের রিভিউ কমিটি ২০১১ সালে ‘সিদ্ধান্তে পৌঁছায়’ যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ‘সবচেয়ে কম’।

“প্রফেসর ইউনূস বরাবরই ব্যাংকটির একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন এবং ব্যাংকটির মুনাফার কোনো অংশ কখনোই তিনি পাননি। ফলে কোন বিচারে তিনি ‘সুদখোর’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন তা একেবারেই বোধগম্য নয়।”

১৯৯৮ সালে বন্যার সময় কিস্তির টাকা আদায় করতে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা ঋণগ্রহীতাদের ঘরের টিনের চাল খুলে নিয়েছিলেন বলে সংসদে তথ‌্য দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

ওই অভিযোগ অস্বীকার করে ইউনূস সেন্টার বলেছে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে সাপ্তাহিক কিস্তি বন্ধ রাখে। সুতরাং বন‌্যার মধ‌্যে কিস্তির জন্য নির্যাতনের অভিযোগ ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’।