২০১৬: অর্থনীতির স্বস্তিতে রিজার্ভ চুরির ধাক্কা

দারিদ্র্য মোচন, প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ আর মূল‌্যস্ফীতির পরিসংখ‌্যানে বাংলাদেশ ২০১৬ সালে অনেক স্বস্তির খবর পেলেও সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের আস্থার জায়গা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে আর্থিক খাতে হ‌্যাকারের হানা।   

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2016, 03:00 AM
Updated : 31 Dec 2016, 03:00 AM

বছরের শুরুতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব‌্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। ফিলিপিন্স কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় দেড় কোটি ডলার বাংলাদেশ ফেরত পেলেও বাকি টাকার কোনো আশা বছর শেষেও দেখা যায়নি।

ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির পর টাকা লোপাটের ঘটনাও গ্রহকদের আস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা দিয়ে যায়।

এ দুটি ঘটনা আর্থিক খাতের নিরাপত্তায় বাংলাদেশের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। 

তবে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর বেশিরভাগ ইতিবাচক অবস্থায় থাকায় সন্তুষ্টি নিয়েই বছর শেষ করার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বিশ্ব ব‌্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমও এ বছর বাংলাদেশে এসে অগ্রগতির প্রশংসা করে গেছেন।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মুহিত বলেন, “আমরা এগিয়ে চলেছি…। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থা বাংলাদেশকে এখন অন্য দৃষ্টিতে দেখে। বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট তো ঢাকায় এসে বলেই গেলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।”

৬ শতাংশের বৃত্তে আটকে থাকা জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবছর ৭ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করেছে। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডরর ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যয়েই আটকে রাখা গেছে। বাড়ছে বিদেশি ঋণ-সহায়তা; রাজস্ব আদায়ের গতিও ভালো।

এ বছর জঙ্গিবাদের নতুন উত্থান চোখ রাঙালেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘সাফল‌্যে’ অর্থনীতিকে খুব বেশি ভুগতে হয়নি। ব্রেক্সিট এখন পর্যন্ত কোনো বিপদ ঘটাতে পারেনি।

গতবছর টানা তিন মাসের অবরোধ-হরতালের পর দেশে নতুন করে আর রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি না হওয়ায় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে বলে মনে করছেন মুহিত।

এর ফলে দেশের বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটতে শুরু করেছে দাবি করে সরকারের নতুন নতুন বড় প্রকল্পে হাত দেওয়ার কথাও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি সাফল্য-ব্যর্থতা বিশ্লেষণে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামগ্রিকভাবে বলা যায়, অর্থনীতি মোটামুটি স্থিতিশীল। সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা ধরে রেখে ৭ শতাংশ অতিক্রম। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে রাখাও আরেকটি সাফল্য। রিজার্ভ, রপ্তানি আয়, রাজস্ব আদায়সহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচকও ভালো।”

তবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে নিম্নগতি, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং ব্যাংকিং খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে না পারাকে ব্যর্থতা হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন রাষ্টায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে তদন্তে সিআইডি (ফাইল ছবি)

রিজার্ভ চুরির ঘটনা চেপে রাখায় চাপের মুখে ১৫ মার্চ গভর্নরের পদ ছাড়ার পর সংবাদ সম্মেলনে আতিউর রহমান

রিজার্ভ চুরিতে টালমাটাল

গত ৪ ফেব্রুয়ারির শুরুতে সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি মেসেজে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপিন্সের কমার্শিয়াল ব্যাংকে। আর আরেক আদেশে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয় ২০ লাখ ডলার।

শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থ ওই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া শেষ পর্যন্ত আটকানো গেলেও ফিলিপিন্সের ব্যাংকে যাওয়া অর্থের বেশিরভাগটাই স্থানীয় মুদ্রায় বদলে জুয়ার টেবিল ঘুরে চলে যায় নাগালের বাইরে।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাইবার চুরির এই ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে ঘটনার এক মাস পর, ফিলিপিন্সের একটি পত্রিকার খবরের মাধ্যমে। বিষয়টি চেপে রাখায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে আনা হয় বড় ধরনের রদবদল। 

ওই ঘটনার তদন্ত করে সরকারের গঠিত তিন সদস্যের কমিটি অর্থমন্ত্রীর হাতে প্রতিবেদন দিলেও মুহিত তা প্রকাশ করেননি। তবে রিজার্ভ চুরিতে জড়িত সন্দেহে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজনের ওপর নজর রাখার কথা বলেছেন পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ডিআইজি (সিআইডি) শাহ আলম।

এদিকে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটির তদন্তের মধ‌্যে কিম অং নামের এক ক্যাসিনো ব্যবসায়ী দেড় কোটি ডলার সে দেশের সরকারের হাতে ফেরত দেন। আদালতের প্রক্রিয়া শেষে ওই অর্থ বাংলাদেশের হাতে আসে।

এরপর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ফিলিপিন্স সফর করে এলেও বাকি প্রায় সাড়ে ৬ কোটি ডলার ফেরত পাওয়ার বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।

ব্যাংকের এটিএম জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার বিদেশি এবং তিন ব্যাংককর্মী।

এটিএম জালিয়াতি

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ঘটনা জানাজানি হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্তে নামে। জানা যায়, ব্যাংকগুলোর ৩৬টি কার্ড ক্লোন করে ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছে জালিয়াতরা। ওই চক্র অন্তত ১২০০ কার্ডের তথ্য চুরি করে বলেও উঠে আসে তদন্তে।

পরে এটিএম বুথের সিসি ক্যামেরার ছবি দেখে এক জার্মান নাগরিক ও তিন ব‌্যাংক কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পিওতর সেজেফান মাজুরেক নামের ওই বিদেশির দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটিএমের বাইরে ব্যাংকিং চ্যানেল ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতিতেও ওই চক্র জড়িত। তাদের হাতিয়ে নেওয়া অর্থের পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা।

মে মাসে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে আরেকটি ব্যাংকের বুথ থেকে আরেক চীনা নাগরিককে ধরার পর পুলিশ জানতে পারে, আরও দুই বিদেশি বিভিন্ন বুথ থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন।    

 

অর্থনীতির চালচিত্র

>> প্রবৃদ্ধির নতুন ধাপে:  এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে ‘আটকে’ থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আশা করছেন, আগামী দিনগুলোতে প্রবৃদ্ধি আর ৭ শতাংশের নিচে নামবে না।

সরকারের প্রত‌্যাশা অনুযায়ী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিতে হলে প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে দুই অংকের বেশি। সেই লক্ষ‌্যে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।

>> মধ‌্যম আয়ের দেশ: মাথাপিছু বার্ষিক আয় এক হাজার ৪৬৫ ডলারে পৌঁছে যাওয়ায় এ বছর জুলাই মাসে বিশ্ব ব‌্যাংক তাদের তালিকায় বাংলাদেশকে নিম্ন মধ‌্যম আয়ের দেশের কাতারে তুলে এনেছে।

বিশ্ব ব‌্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশে ‘অতিদরিদ্র’ মানুষের সংখ‌্যা এখন মোট জনগোষ্ঠীর ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পারচেজিং পাওয়ার পেরিটি) বাংলাদেশের ১২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯ ডলারের (১১৫ টাকা) কম। এই হার ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানের চেয়েও ভালো।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে হতদারিদ্র্যের হার ‘শূন‌্যে’ (৩ শতাংশের নিচে নেমে এলেই তাকে শূন‌্য ধরা হবে) নামিয়ে আনার যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে বলে বিশ্ব ব‌্যাংকের অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ‌্য আশা করছেন, ২০২৪ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ এসডিজির এ লক্ষ‌্য অর্জন করবে।

>> মূল্যস্ফীতিতে লাগাম

বেশ কিছুদিন ধরেই অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) সর্বশেষ নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর ১২ মাসের গড় হিসেবে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

গত অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। অর্থবছর শেষে দেখা যায়, সেই হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৮ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য রয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কয়েক বছর ধরে বাম্পার ফলন ও বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের কম থাকায় মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা সহজ হয়েছে। আগামীতেও তা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করছেন।

>> ৩২ বিলিয়নের উচ্চতায় রিজার্ভ

গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার গত ৪ নভেম্বর অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে তিন হাজার ২০০ কোটি (৩২ বিলিয়ন) ডলার ছাড়ায়। যা দিয়ে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

তবে ৭ নভেম্বর এশিয়ান কিলয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের তা কমে যায়। ডিসেম্বরের শেষে তা ফের ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। গতবছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এলে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বলে ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কিলয়ারিং ইউনিয়নের আমদানি বিল বকেয়া রাখতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়েছে ৩২ গুণ।

>> রাজস্ব আদায়

২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। ওই অংক ছিল আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি।

চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে এগোনোর পথে প্রথম চার মাসে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান আশা করছেন, রাজস্ব আদায়ে এবার লক্ষ্য পূরণ হবে।

 

>> আমদানি-রপ্তানি-ভারসাম্য

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের কম দামের কারণে গত দুই বছর ধরে সামগ্রিক আমদানিতে ‘ধীরগতি’ দেখা গেলেও ২০১৬ সালের শেষ দিকে অবস্থা কিছুটা বদলানোর ইংগিত মিলেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আমদানি ব‌্যয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ শতাংশ বেড়েছে।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।

অন‌্যদিকে রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা ২০১৬ সালেও ধরে রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষ করেছিল বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে। তবে জুলাই-অক্টোবর সময়ের যে তথ‌্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে, তাতে লেনদেন ভারসাম্যে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারের ঘাটতি (ঋণাত্মক) দেখা দিয়েছে।

>> বিনিয়োগে গতি আসেনি

দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ এরইমধ‌্যে অর্ধেক শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে বাকি কাজও শেষ হবে আশা করছে সরকার। এছাড়া আরও কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে গতি আসেনি।

অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বলছেন, ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অলস অর্থ পড়ে আছে; বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ যতোটা বাড়ার কথা ছিল ততোটা বাড়েনি।

তবে বছরের শেষ দিকে এসে আমদানি ব্যয় বাড়ার মধ‌্যে বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির এলসি খোলার (ঋণপত্র) পরিমাণ বেড়েছে ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর এলসি নিস্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও জুলাই-অক্টোবর সময়ে ১ শতাংশের মত বেড়েছে।

গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ছিল ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এবার অক্টোবর শেষে এই প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সরকারের ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২৩ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাস্তবায়নের হার ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত বছরে এই পাঁচ মাসে বাস্তবায়নের হার ছিল ১৭ শতাংশ।

>> চোখ রাঙাচ্ছে রেমিটেন্স

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন‌্যতম প্রধান চালিকা শক্তি বিদেশে থাকা কর্মীদের পাঠানো অর্থ; আর তাতেই দেখা দিয়েছে খরা।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৫২০ কোটি ৭১ লাখ (৫.২০ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম।

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বে ব‌্যয় সংকোচনের কারণে প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়ায় তারা অর্থ কম পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি অবৈধ হুন্ডিও রেমিটেন্স কমার একটি কারণ।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারি এবং বেসিক ব্যাংকে অর্থ লুটপাটের রেশ এখনও কাটেনি ব্যাংক খাতে। ব্যাংকগুলোতে এক লাখ কোটি টাকার বেশি অলস অর্থ (বিনিয়োগ আসছে না এমন অর্থ) পড়ে আছে। সে কারণে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ হার কমিয়েই চলেছে।

বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের আরেক সমস্যা। অবলোপন মিলিয়ে (রাইট অফ) ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।