দারিদ্র্য জয়ের গল্পে মঙ্গাকে বিদায়ের ঘোষণা

কেউ স্বামী হারিয়ে অকূল দরিয়ায় পড়েছিলেন, কেউ করতেন ভিক্ষা, কেউবা কঠিন পরিশ্রম করেও সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারার কষ্টে দিন পার করতেন। এ সবই এখন তাদের জীবনে গল্প হয়ে গেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2016, 12:12 PM
Updated : 30 Nov 2016, 12:16 PM

তারা সবাই এখন স্বাবলম্বী, পল্লী উন্নয়ন কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) এক দশকের কার্যক্রমে পাল্টে গেছে তাদের জীবন।

যে কর্মসূচি নিয়ে পিকেএসএফ এদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, ‘মঙ্গা নিরসনে সমন্বিত উদ‌্যোগ-সংযোগ’ শীর্ষক সেই কর্মসূচির সমাপনী অনুষ্ঠানে এসে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, এ কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে ‘মঙ্গা’ শব্দটিকেও বিদায় দেওয়া হলো। আর কখনই এই শব্দের ব‌্যবহার তিনি চান না।

প্রধান অতিথির বক্তব‌্যে মুহিত বলেন, “গ্রামীণ ব‌্যাংকের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পল্লী কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি করার সময় কারও সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ সরকার নিজেই এটা করে।”

আগামী আট বছর পর বাংলাদেশে আর দারিদ্র্যও থাকবে না বলে মন্তব্য করেন মুহিত।

‘দারিদ্র্যজয়ী’ বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ এ অনুষ্ঠানে দর্শক-শ্রোতাদের সামনে নিজেদের জীবনের গল্প তুলে ধরেন।

নীলফামারির জাহিরা বেগম বলেন, বেশি সন্তান হওয়ার কারণে বাবা তাদের বেশিদূর লেখাপড়া করাতে পারেননি। তারই মধ্যে ১৩ বছর বয়সে এক বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় কম যৌতুক নেবে বলে।

“বিয়ের পর যৌতুকের জন্য শ্বশুর শাশুড়ীর চাপ, অল্প বয়সে বাচ্চা- কী করি। অনেক এনজিওতে গেছি, কেউ আমাকে সহায়তা দেয়নি। পরে কচুকাটা মহিলা দলে যোগ দিয়ে দেশি মুরগি লালন পালন প্রশিক্ষণ নিই। তিন হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কাজ শুরু করি।”

এরপর মুরগীর বাচ্চা ও ডিম বিক্রি করে সেই ঋণ শোধ করেছেন জাহিরা। নতুন করে আট হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পাশের বাজারে স্বামীকে একটি পানের দোকানও করে দিয়েছেন।

“নীলফামারিতে আমি ম্যাট বানানোর জন্য ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ নিছি। প্রশিক্ষণে প্রতিদিন ১৪০ টাকা করে দিছে। ওখান থেকে পাঁচ হাজার টাকায় ব্যবসা শুরু করি। পরে ঋণ নেওয়া শুরু করি। ছোট ছোট ঋণ নিয়ে এখন আমার ৭০ হাজার টাকা ঋণ। আমি এখন খুবই ভালো আছি।”

২০১০ সালে ম্যাট বানানোর প্রশিক্ষক হন জাহিরা। এখন তার অধীনে কাজ করছেন ৭৫ জন। তাদের তিনি টাকা, সুতা দেন।কাজ শেষে ফুট মেপে ম্যাটের দাম চুকান। সেই ম্যাট বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করাই তার ব্যবসা।

জাহিরা বললেন, তার মতো নারীদের কাছে সরকার গেলে ‘বাংলাদেশে আর কেউ গরিব থাকবে না’।

গাইবান্ধার শাহেদ জামাল জানান, এক সময় তিনি ভ্যানচালক ছিলেন। তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে ‘পাঁচজন খানেওয়ালা’র জন্য প্রতিদিনের খাবার জোগাড়ে হিমশিম খেতে হত তাকে। অভাবে অনটনে তার দিন কাটত।

পিকেএসএফের একটি প্রকল্প থেকে কেঁচো নিয়ে খামারি হওয়া শাহেদ অনুষ্ঠানে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “এক বর্ষাকালে আমাকে সাত দিন ধরে খুদ বিরিয়ানি খেতে হয়েছে। আমার ছেলে বলেছিল, সে আর ওই খাবার খেতে পারছে না। বাজার থেকে আমি যেন এক কেজি চাল নিয়ে আসি। আমি তাকে বলেছিলাম, আমার কাছে কোনো টাকা নাই।

“তখন আমিনুল স্যার (পিকেএসএফের সহযোগী এনজিওর কর্মকর্তা) আমার কাছে প্রতিদিনই আসেন। তিনি খুদ খাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেন।”

জবাবে শাহেদ প্রথমে বলেছিলেন, ‘খুদ বিরিয়ানি’ তার পছন্দের খাবার। কিন্তু পরে সত্যি কথা বলেন। তখন এই এনজিও কর্মকর্তা তাকে টাকা ধার দিয়ে বাজার থেকে এক মন চাল কিনে দেন। কেঁচো সার বিক্রি করে পরে সেই টাকা শোধ করেন শাহেদ।

“আজকে আমার মাসে ৫০ মন সার বাহির (উৎপাদন) হয়। সব সময় কয়েকজন কর্মী আমার বাড়িতে কাজ করে। কত সুখী আজকে…..।”

নিজের জীবনের মর্মস্পর্শী কাহিনী শোনান নীলফামারী থেকে আসা আমেনা বেওয়া। এক সময় তার জমি ছিল। কিন্তু স্বামী তালাক দেয়, জমিও নদীতে ভেঙে নেয়। তারপর দীর্ঘদিন তাকে বাস করতে হয় বাঁধের ওপরে।

“দশবাড়িতে চাইয়া মাড় খাইয়া থাকতাম। পরে একদিন এনজিও আইসা আমার নাম তালিকায় দিছে, তখন আমি বাড়িত ছিলাম না। ভিক্ষা করতে গেছি।

“পরে ৪৫ দিন মাটি কাটি, প্রতিদিন ৭৫ করে টাকা পাই। তখন সুমতিতে (সমিতি) ঢুকিয়া দুই হাজার টাকা টাকা ঋণ নিয়ে ছাগল কিনেছি। আশপাশে ছাগল চরাই আর ভিক্ষা করি। তিন বছর পর আমি আর ভিক্ষা করতে যাই নাই।”

মাঝে একবার দুই লাখ ত্রিশ হাজার টাকার ছাগল বিক্রি করার কথা জানিয়ে তিন বলেন, “এর মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় জমি বন্ধক নিছি। সেখান থেকে ফসল পাই। আমি এখন খুবই সুখে আছি।”

আমেনার এখন আছে গরু আছে পাঁচটি, ছাগল ২২টি, গাভী তিনটি আর বাছুর দুইটি।

দারিদ্র্য বিমোচনে দীর্ঘ মেয়াদে কারও পাশে দাঁড়াতে হবে জানিয়ে পিকেএসএফ চেয়ারম‌্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, “আমরা ক্ষুদ্র ঋণের মানবিকীকরণ করেছি। কাউকে ঋণ দিলেই হয় না। তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, প্রযুক্তি দিতে হবে, বাজারজাতকরণে সহায়তা দিতে হবে।”

“আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়। এটা বহুমাত্রিক বিষয়। এটাকে ধারণ করার চেষ্টা করছি।”

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব আহমেদ, ডিএফআইডির  ‘প্রবৃদ্ধি ও বেসরকারি খাত উন্নয়ন’র টিম লিডার কেইথ থমসন প্রমুখ।

সংযোগ কর্মসূচির সমাপনী উপলক্ষ্যে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৃহত্তর রংপুরে ২০০৬ সালে এই কর্মসূচি শুরু হয়। ২০০৭ সাল থেকে ডিএফআইডি এই কর্মসূচিতে আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করে। ২০১০ সালে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ও জামালপুরে এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হয়।

এই সময়ে দুই হাজার ৩৮৫ কোটি ৯০ লাখ টাকার নমনীয় ঋণ, ৭০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার আপতকালীন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। কর্মসূচির আওতায় দুই লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৫ জনকে কৃষিজ ও অকৃষিজ বিষয়ক দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।