রেমিটেন্সে নিম্নগতি চোখ রাঙাচ্ছে অর্থনীতিকে

বিশ্বে মন্দার মধ‌্যে যার উপর ভর করে বাংলাদেশ রিজার্ভ সুসংহত রাখতে পেরেছে, সেই রেমিটেন্সে দেখা দিয়েছে খরা।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2016, 02:41 PM
Updated : 2 Nov 2016, 03:10 PM

প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই কমেছে। সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে তা আরও কমে ১০১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

রেমিটেন্সের এই অধঃগতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে পড়বে বলে উদ্বেগ এসেছে অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন‌্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হল বিদেশে থাকা কর্মীদের পাঠানো অর্থ। ২০১৫ সালে মোট জাতীয় আয়ের ১৩ শতাংশ অবদান ছিল এই রেমিটেন্সের।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বুধবার প্রকাশিত রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিটেন্স এসেছে ৪২৫ কোটি ৫৭ লাখ (৪.২৫ বিলিয়ন) ডলার।

এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ কম।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৫০৩ কোটি ২১ লাখ (৫.০৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল।

এই প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে এখন ভাটার টান

গত তিন মাস ধরে কমতে কমতে সর্বশেষ অক্টোবর মাসে ১০১ কোটি ৯ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে। তা সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং গত বছরের অক্টোবর মাসের চেয়ে ৮ শতাংশ কম।

রেমিটেন্সের এই পড়তি সামষ্টিক অর্থনীতিতে ‘নেতিবাচক’ প্রভাব ফেলবে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, টানা তিন মাস রেমিটেন্সের এই নেতিবাচক ধারায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

“আগামী মাসগুলোতেও যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উর্ধ্বমুখী গতি হোঁচট খেতে পারে।”

বিশ্ব মন্দার মধ‌্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর এবার ৭ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ‌্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।

রেমিটন্স প্রবাহ কমে যাওয়াকে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে দেখছেন বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম, রেমিটেন্স প্রবাহে নিম্নমুখী এবং ব্রেক্সিটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধাক্কার প্রভাব।”

জাহিদ হোসেন

বিশ্বে ব‌্যয় সংকোচনের কারণে প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়ায় তারা দেশেও অর্থ কম পাঠাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধ হুন্ডির মাধ‌্যমে অর্থ পাঠানোকেও হিসেবে দেখাচ্ছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

ব্যাংকসহ বৈধ পথে বিদেশি মুদ্রার হিসাব কষে রেমিটেন্সের তথ্য দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে আসা অর্থের হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে থাকে না।

অগ্রণী ব‌্যাংকের চেয়ারম‌্যান জায়েদ বখত বলেন, বিভিন্ন দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে লাভের আশায় হুন্ডির মাধ্যমে স্বদেশে অর্থ পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন প্রবাসীরা।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আগে সিঙ্গাপুর থেকে ১ ডলার পাঠালে যে টাকা পাওয়া যেত, এখন ওই দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে কম টাকা পাওয়া যাচ্ছে। সে কারণেই একটু বেশি টাকার প্রত্যাশায় অনেক প্রবাসী এখন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন।”

হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে বরাবরই দর ব‌্যাংকের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়।

জায়েদ বখত

মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে রেমিটেন্সের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিআইডিএসের গবেষক জায়েদ বখত।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক সরকারি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদেশে কর্মরত ৮৬ লাখ বাংলাদেশির পাঠানো অর্থের ৭৮ শতাংশ আসে ব‌্যাংকের মাধ‌্যমে। হুন্ডির মাধ্যমে আসে ১২ শতাংশ।

হুন্ডির এই হার এখন বেড়ে গেছে বলে মনে করেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১০০ কোটি ৫৫ লাখ রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। অগাস্ট মাসে তা বেড়ে ১১৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার হয়েছিল।

তারপর থেকেই কমছে রেমিটেন্স। সেপ্টেম্বরে তা কমে ১০৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। অক্টোবরে তা আরও কমল।

গত জুলাই থেকে অগাস্টে রেমিটেন্স বাড়লেও গত বছরের তুলনায় তা ছিল কম।  

গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৩৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। অগাস্ট মাসে আসে ১১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৩৫ কোটি ডলার, অক্টোবরে ১১০ কোটি ডলার।

 

গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিটেন্স ২ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছিল। তবে আগের অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছিল।

রেমিটেন্স কমলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এখনও সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।

বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।

দু-একদিনের মধ্যেই রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করবে বলে আশা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

আমদানি ব্যয় কমে যাওয়া এবং বিদেশি ঋণ-সহায়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে রিজার্ভ এই সন্তোষজনক অবস্থায় অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন জায়েদ বখত ও জাহিদ হোসেন।

রপ্তানি আয় বৃদ্ধিও রিজার্ভ বাড়ার একটি কারণ বলে মনে করেন তারা।

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি।

এই তিন মাসে গত বছরের তিন মাসের চেয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৪ দশমিক ১২ শতাংশ।