ব্যয়বহুল সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ নিয়েও সংশয়

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ৩৩৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ‌্যুৎকেন্দ্রটি বিশ্বের সবচেয়ে ব‌্যয়বহুল বিদ‌্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2016, 01:52 PM
Updated : 18 Sept 2016, 01:52 PM

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এই তথ‌্য তুলে ধরে এই প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।

তবে ‘সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্প’র পরিচালক নাজমুল আলম ব‌্যয় ‘যথাযথ’ বলেই মনে করছেন। এই বছরের মধ‌্যে কাজ শেষ করার বিষয়েও আশাবাদী তিনি।

গ্যাসভিত্তিক এই বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ চার বছরে শেষ করার কথা থাকলেও তা এখনও শেষ হয়নি।

এর মধ‌্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি প্রকল্পটি নিয়ে ব্যক্তি পরামর্শক প্রকৌশলী আবু বকর মো. মমশাদ মাশরেকীকে দিয়ে একটি নিবিড় পরিবীক্ষণ চালান।

তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিদ্ধিরগঞ্জের এই বিদ‌্যুৎকেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াটে ব্যয় হচ্ছে ৯৬১ ডলার, যা সারাবিশ্বে সম্প্রতি তৈরি বা নির্মাণাধীন একই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের মধ‌্যে সবচেয়ে বেশি।

# দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল বিদ‌্যুৎকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডমিনিয়ন ভার্জিনিয়া পাওয়ার প্লান্ট’, প্রতি কিলোওয়াটের জন‌্য নির্মাণ ব্যয় ৯৫৫ ডলার।

# তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র পাকিস্তানের ‘পাকিস্তান ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানি, সিন্ধু’, প্রতি কিলোওয়াটের নির্মাণ ব্যয় ৮৫৪ ডলার।

# চতুর্থ সর্বোচ্চ বাংলাদেশেরই ‘হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট’, প্রতি কিলোওয়াটে নির্মাণ ব্যয় ৮৪৭ ডলার।

# পঞ্চম সর্বোচ্চ যুক্তরাষ্ট্রের ‘এফ জি ই পাওয়ার টেক্সাস’, এর কিলোওয়াটে নির্মাণ ব্যয় ৮০০ ডলার।

বাংলাদেশে একই ধরনের হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সিদ্ধিরগঞ্জ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় ও নির্মাণ সময় অনেক বেশি।

হরিপুর কেন্দ্রটি নির্মাণে যেখানে ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা, সেখানে সিদ্ধিরগঞ্জের মোট ব্যয় ৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।

হরিপুরে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০১৪ সালের এপ্রিলে কাজ শেষ হয়। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১২ সালে, প্রায় চার বছর পরও ২২ শতাংশ কাজ বাকি।

‘টার্নকি’ পদ্ধতিতে নির্মিত অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করলেও দেখা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা কম হলেও চুক্তিমূল্য অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে তুলনামূলক বেশি।

সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি মূল‌্য ৩২ কোটি ২০ লাখ ডলার। হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তিমূল্য ৩৪ কেটি ৯০ লাখ ডলার। আশুগঞ্জ উত্তর ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি মূল‌্য ২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার।

ব‌্যয়ের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নাজমুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইএমইডি এক ব্যক্তি পরামর্শক দিয়ে এই পরিবীক্ষণ করিয়েছে। পরামর্শক কোন বিবেচনার ভিত্তিতে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন সেটা আমার জানা নেই।

“বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশিরভাগই বিদেশি যন্ত্রপাতি কিনে স্থাপন করতে হয়। তাই পণ্যের গুণগত মান ও কোন দেশি পণ্য তার উপরও দাম নির্ভর করে। তাই এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দাম যথাযথই ধরা হয়েছে।”

আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যয়ের এ কেন্দ্রটিতে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশায় ডুয়েল ফুয়েল ব্যবহারের ব্যবস্থা না থাকায় প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া অন্য কোনো জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ‌্যাসের স্বল্পতার কারণে বিকল্প জ্বালানি ব‌্যবহারের সুবিধা না রাখার বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

২০০৭ সালে একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছিল। পরে কয়েকদফা পরিবর্তন ও সংশোধনের পর ২০১২ সালে স্পেনের আইসোলাক্স ইঞ্জিনিরিয়া এস এ এন্ড স্যামসাং সি এন্ড টি ক্রর্পের সঙ্গে চুক্তি হয়।

চার হাজার ১৪৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এছাড়াও সরকারি তহবিল থেকে ৬০৯ কোটি এবং বাস্তবায়নকারি সংস্থা ইজিসিবির তহবিল থেকে ৪৩৫ কোটি টাকা জোগান দেওয়া হচ্ছে।

গণমাধ‌্যমে খবর এসেছে, স্পেনের আইসোলাক্সের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তারা বাংলাদেশের বিদ‌্যুৎকেন্দ্রটির কাজ বন্ধ রেখেছে।

আইএমইডির পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো বিষয় চুক্তিতে সুনির্দিষ্ট না থাকায় কারণে অথবা অস্পষ্টতা থাকার কারণে ঠিকাদারের সঙ্গে বাস্তবায়নকারী সংস্থার বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়। এছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারের সাব-কন্ট্রাক্টরের মধ্যে বিরোধের কারণেও কাজও বন্ধ আছে। ফলে প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ ভৌত অগ্রগতি হলেও মূল কাজ টারবাইন বসানো এখনও বাকি রয়ে গেছে।

“এ অবস্থায় সময় মতো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কি না, সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে নির্মাণকালীন সুদও বেড়েই চলছে।”

তবে প্রকল্প পরিচালক নাজমুল এই সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, “আশা করছি, এই বছরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।”

এই প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে বাস্তবায়নকারী সংস্থা ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল হক মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মাত্র ছয় মাস আগে এসেছি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের টেন্ডারিংয়ের সময় আমি ছিলাম না। তাই আমি কিছু বলতে পারব না।”