বাজেট: অর্থনীতিবিদরা যেমন দেখছেন

নতুন অর্থবছরের জন্য সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তার আকার নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা না দেখলেও বাস্তবায়নে সরকারকে অনেক খাটতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।   

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2016, 05:57 PM
Updated : 2 June 2016, 06:07 PM

বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ার প্রশংসা এলেও বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও  মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনার ‘স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি’ বলে মত এসেছে। 

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ ধরে বৃহস্পতিবার এই বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন।  

বড় খরচ মেটাতে বাজেটে মূল্য সংযোজন করে মনোযোগ বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।

৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করে নতুন অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে রাখার আশার কথা শুনিয়েছেন মুহিত।

বাজেটের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘ইতিবাচক পথে’ থাকারই ইঙ্গিত তিনি পাচ্ছেন।

সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সংশয় প্রকাশ করেছেন বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে। আর গবেষক জায়েদ বখত কিছু ক্ষেত্রে এ বাজেটকে ‘ইতিবাচক’ মনে করলেও হতাশা প্রকাশ করেছেন কয়েকটি ক্ষেত্রে স্পষ্ট কোনো চিত্র না পেয়ে। 

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

স্বপ্ন পূরণের বাজেট: ফরাসউদ্দিন

নতুন অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রশংসা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন; বলেছেন, রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য সরকার ঠিক করেছে, সেজন্য অনেক খাটতে হবে, বাড়াতে হবে এডিপি বাস্তবায়নের দক্ষতা। 

“নতুন বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশ বেড়েছে। বাজেটে ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে। আর আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ।

“এ হিসাবে আমাদের মাথাপিছু আয় ৬ শতাংশ হারে বাড়বে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিবাচক পথে থাকারই ইঙ্গিত দেয় বলে আমি মনে করি।”

চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৯ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট এবার দিয়েছেন, তাকে উচ্চাভিলাষী বলতে রাজি নন সাবেক এই গভর্নর। 

“আমার বিবেচনায় এই বাজেট মোটেই উচ্চাভিলাষী নয়। প্রস্তাবিত বাজেট জিডিপির ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ এটা হওয়ার কথা তিন ভাগের এক ভাগ।”

বাজেটে এবার ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে তাকেও ‘রক্ষণশীল’ বলেছেন ফরাসউদ্দিন।

“চলতি অর্থবছরেই ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। অভ্যন্তরীণ, আন্তর্জাতিক সবকিছুই অনুকুলে। আসছে অর্থবছরের জন্য এই লক্ষ্যমাত্রা আরও বেশি ধরা যেত…।”

সার্বিক বিবেচনা থেকে এবারের বাজেটকে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অর্থনৈতিক মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার বাজেট’ অভিহিত করেছেন তার সাবেক একান্ত সচিব ফরাসউদ্দিন।

“আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, এই বাজেট ওই পথে নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি।”

তবে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা পূরণ করতে ‘অনেক চেষ্টা করতে হবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ষোল কোটি মানুষের দেশে মাত্র ১২ লাখ লোক কর দেয়। এই সংখ্যা না বাড়তে পারলে রাজস্বও বাড়বে না।

“কর কর্মকর্তাদের অনেক বেশি মেহনত করতে হবে। আন্তরিক হতে হবে।”

সেই সঙ্গে এডিপি বাস্তবায়ন বাড়াতে ‘অবশ্যই জোর দিতে হবে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“কাজের মান নিশ্চিত করতে হবে। বাস্তবভিত্তিক প্র্রকল্প নিতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কোন প্রকল্প নিলে হবে না। মানুষের উপকার হয়, দেশের উন্নয়ন হয়-এমন প্রকল্পই নিতে হবে।”

এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

বাস্তবায়ন দুঃসাধ্য হবে: মির্জ্জা আজিজুল

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করছেন, সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার এই বাজেট বাস্তবায়ন সরকারের জন্য ‘দুঃসাধ্য হবে’।

তার মতে, বিগত বছরগুলোর মত প্রকৃত রাজস্ব আদায় ও উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে বাজেটের লক্ষ্যের ‘ফারাক’ থেকে যাবে এবারও।

“সাম্প্রতিককালে কয়েকটি বাজেটেই দেখতে পাচ্ছি যে, বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে তার সঙ্গে বছর শেষে যে বাস্তবায়ন হচ্ছে তার তফাতের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। এই বছরেও মনে হয় তার ধারাবাহিকতাই বজায় থাকবে।”

বিশেষ করে রাজস্ব আহরণ; এনবিআরের কর রাজস্ব, কর বহির্ভূত রাজস্ব এবং এডিপি বাস্তবায়নে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ‘অর্জন করা সম্ভব হবে না’ বলেই মির্জ্জা আজিজের ধারণা।

প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎসের অর্থায়ন থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার যে আশা অর্থমন্ত্রী করছেন, সেখানেও সমস্যা দেখছেন মির্জ্জা আজিজ।  

“বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা খুব বেশি বড় না। সমস্যা হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ তো আমরা ব্যবহার করতে পারি না। পাইপলাইনে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার জমে আছে। এখানে ঋণ পাওয়াটা সমস্যা না, সমস্যাটা হচ্ছে ব্যবহার করা।”

# ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। পরে তা ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

# এবার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এনবিআরের কর হিসেবে আসবে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।

# এবার ভ্যাট থেকে ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক হয়েছে। এই অংক বিদায়ী বছরের তুলনায় ৩৫% বেশি।

# ২০১৫-১৬ অর্থবছর ভ্যাট থেকে ৬৪ হাজার ২৬২ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হলেও পরে তা কমিয়ে ৫৩ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা করা হয়।

# এডিপিতে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা এবারের সংশাধিত বাজেটে ৯১ হাজার কোটি টাকা ছিল।

জায়েদ বখত

আশা আছে, হতাশাও: জায়েদ বখত

বেসরকারি বিনিয়োগে সন্তোষজনক অগ্রগতি না থাকা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে কথা উঠলেও এবারের বাজেটে এক্ষেত্রে আশার আলো দেখছেন অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত।

তার ভাষায়, বাজেট বড় হওয়াটা এক্ষেত্রে ‘ইতিবাচক’, কেননা তা আগের ধারবাহিকতায় এসেছে।

“বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার সময়েও এই সম্প্রসারণমূলক বাজেটের সুফল আমরা পেয়েছি।”

বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলছেন, বাজেটে বড় প্রকল্পের জন্য বিশেষ বাজেটের উদ্যোগ সফল হলে তা বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখবে।

“সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি হলেই সবকিছু হবে না। এখন বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এ জন্য নানা উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিতে গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পগুলোর জন্য আলাদা বাজেট দেওয়া হয়েছে। এটা সফল হলে বেসরকারি বিনিয়োগে ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে।”

জায়েদ বখত বলছেন, বিনিয়োগে পুঁজির অভাব নিয়ে সমস্যা কাটাতে ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ সমাধানের পথ দেখাতে পারে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য ইপিজেডের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

“কয়েকটি ইপিজেড হয়ে গেলেও সেটা সাকসেস স্টোরি হবে।”

তবে বাজেটের বেশ কিছু দিক নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করেছেন এই অর্থনীতিবিদ।

“বিদ্যুৎ জ্বালানি গ্যাস সিরিয়াস সমস্যা। কিন্তু সেখানে বলা হয়েছে, কাজ চলছে। এটা স্পষ্ট হলো না। অথ্চ স্বল্প মূল্যের উৎপাদনের জন্য এটা প্রয়োজন।এ বিষয়ে চলা প্রকল্পগুলোও দ্রুত বাস্তবায়নের কোনো নির্দেশনা নাই।”

করপোরেট ট্যাক্স কেবল গার্মেন্টেসের ক্ষেত্রে না কমিয়ে আরও ‘বেশ কিছু ক্ষেত্রে’ তা করা উচিৎ ছিল বলে মত দেন জায়েদ বখত।

“আমরা ভারত থেকে, শ্রীলঙ্কা থেকে ব্যবস্থাপক নিয়ে আসছি।  নিজেদের জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন করে এটা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু বাজেটে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি। আমাদের এখন দরকার খুব টার্গেটেডলি মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রোগ্রাম। প্রায়োরিটিতে এটা সুনির্দিষ্ট করতে হবে।”