বাস্তবায়ন না হলে বড় বাজেটে লাভ কী: মির্জ্জা আজিজ

প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া বাজেট বাস্তবায়নের ‘বেহাল দশা’ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হয়ে দুটি বাজেট দেওয়া এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2016, 02:41 AM
Updated : 19 June 2016, 03:22 PM

তিনি বলেছেন, “বাস্তবতার সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। অর্থ বরাদ্দ দিলেই হবে না, সেটা ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কি না, কাজ সময়মতো শেষ হচ্ছে কি না- তা নিশ্চিত করতে হবে।”

গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার এডিপি বাস্তবায়নের হার কম জানিয়ে তিনি বলেন, “শুধু শুধু অসম্ভব টার্গেট নিয়ে লাভ কী; যদি সেটা বাস্তবায়ন করা না যায়?”

২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট সংসদে উপস্থাপনের আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরামর্শ দেন মির্জ্জা আজিজ।

আগামী ২ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন, যার আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে আভাস এসেছে।

সেই বাজেট উপস্থাপনের এক সপ্তাহ আগে এর আকার, বিনিয়োগ পরিস্থিতি, রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবেলার কৌশল নিয়ে কথা বলেছেন ২০০৭-০৮ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: অর্থমন্ত্রী এবার সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমি মনে করি, প্রথমেই বাজেটের টার্গেট ঠিক করতে হবে। শুধু শুধু উচ্চাভিলাষী-অসম্ভব টার্গেট নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, বাস্তবসম্মত বাজেট দিতে হবে। আমি হিসাব করে দেখেছি, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটকে ভিত্তি ধরলে আগামী বাজেটের আকার বাড়বে ২৯ শতাংশের মতো, যা অবাস্তব বৃদ্ধি বলে আমি মনে করি।

সে কারণেই আমি বলছি, বাস্তবতার সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।

[চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। কাটছাঁটের পর সংশোধিত বাজেট দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা।]

নতুন বাজেটে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ইতোমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বরাদ্দসহ হিসাব করলে এডিপির আকার দাঁড়াবে ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

প্রতিবছরই বিশাল আকারের এডিপি হাতে নেওয়া হচ্ছে। সাত-আট মাস পর কাটছাঁট করে সেটা আবার কমিয়ে আনা হয়। আর বছরের শেষ দুই-তিন মাসে তাড়াহুড়া করে সেটা বাস্তবায়ন করা হয়। তাতে করে অর্থ খরচ হয় ঠিকই, কিন্তু কাজের মান ভালো হয় না।

এ থেকে আমাদের পরিত্রাণ দরকার। বাজেট বাস্তবায়নে প্রাক-প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রশসনিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে।

আমার কাছে যে তথ্য আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে, অর্থাৎ জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৫১ দশমকি ৩৪ শতাংশ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এ হার সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরে এই বাস্তবায়নের হার ছিল ৫৬ শতাংশ।

অর্থবছর শেষ হতে বাকি আর দুই মাস। প্রতিবছরের মতো এবারও শেষ দিকে প্রকল্প ব্যয়ের চাপ থেকে যাচ্ছে। এর ফলে এডিপির গুণগত বাস্তবায়ন নিয়ে যে কারও প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক।

[চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ছিল ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ছয় হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে ৬ এপ্রিল তা ৯১ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।]

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্যের দাম কম। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে বলে আপনি মনে করেন?

এ কথা ঠিক যে, তেল ও খাদ্যের কম দাম আমাদের অর্থনীতিতে এক ধরনের স্বস্তি এনে দিয়েছে। তাই এবারও অর্থমন্ত্রী বেশ আয়েশের মধ্যেই বাজেট দিতে পারছেন। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে একটা উদ্বেগের বিষয় কিন্তু আছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স নেগেটিভ।

চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ রেমিটেন্স কম এসেছে। বাকি দুই মাসও এই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির প্রাণ কিন্তু এই রেমিটেন্স। বলা হয়ে থাকে, প্রবাসীরাই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। এক্ষেত্রে বাজেট দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রীকে একটু সমস্যায় পড়তে হবে বলে মনে হচ্ছে।

অন্যদিকে একটা ইতিবাচক খবরও আছে। রপ্তানি আয় বেশ খানিকটা বেড়েছে। ১০ মাসের হিসাবে এ খাতে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১০ শতাংশের মতো। এদিক দিয়েও এক ধরনের স্বস্তির মধ্যে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

[২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এপ্রিল শেষে এই হার দাঁড়িয়েছে তারও কম, ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। নতুন বাজেটে এই মূলস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে] 

অনেক চেষ্টার পরও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে ঠিক; তবে এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ আছে- এটা স্বীকার করতে হবে। রাস্তাঘাট-ফ্লাইওভার হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের জন্যও উদ্যোগ আছে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসছে…। আমার মনে হয় দেশে বর্তমানে যে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে, সেটা অব্যাহত থাকলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের খরা কেটে যাবে।

তবে এখানে আমি আবারও সেই একই কথা বলতে চাই, রাস্তাঘাট-এডিপি বাস্তবায়ন সবকিছুই সময়মতো শেষ করতে হবে। তাহলেই তার সুফল পাওয়া যাবে।   

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটের কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন।

বাজেট নিয়ে আলোচনায় আমি সব সময়ই বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছি। এখনও সেটাই করছি।

নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী বড় (মেগা) প্রকল্পগুলোর জন্য আলাদা বরাদ্দ বা বাজেটের কথা বলছেন। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

সরকারের এ উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন শুরু করে সাহসের পরিচয় দিয়েছে সরকার। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এ ধরনের আরও অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে আমাদের।

নতুন বাজেটে পদ্মা সেতু, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী এই বড় বড় প্রকল্পের জন্য আলাদা বাজেটের যে কথা বলছেন, সেটাকেও আমি স্বাগত জানাই।

দেশে বেশ কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। নিকট ভবিষ্যতে একই পরিস্থিতি থাকবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশা করছেন। এ অবস্থায় নতুন বাজেট বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কতটা সহায়ক হবে বলে আপনি মনে করেন?

বাংলাদেশ স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের সুফল পাচ্ছে- এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার মধ্যেও প্রবৃদ্ধির এই ধারা ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ। এখন ৭ শতাংশের ঘর আতিক্রম করছে…। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে আরও গতি সঞ্চার হবে। বিনিয়োগ বাড়বে; কর্মসংস্থার হবে। তার সুফল দেশের মানুষ পাবে।

[২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্য হিসাব করে যে তথ্য দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে এবার ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। নতুন বাজেটে এই প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে।]

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনাকে ধন্যবাদ।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।