কর হারে লাভ থাকতে হবে দুপক্ষেরই: ফরাসউদ্দিন

করদাতার সংখ্যা বাড়ানো গেলে কর হার কমিয়েও বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব; আর সেই পথেই বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পথ দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2016, 04:22 AM
Updated : 25 May 2016, 04:51 AM

তিনি বলেছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে সরকার ও করদাতা- দুপক্ষই যাতে লাভবান হয়, সে উপায় বের করতে হবে।

“যদি সবাই মিলে করদাতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো যায় তাহলে কর হার কমিয়েও বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব।”

আসছে ২ জুন জাতীয় সংসদে এবারের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। নতুন বাজেটের আকার তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে বলে এরই মধ্যে ধারণা দিয়েছেন তিনি।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের এই বাজেট সামনে রেখে সোমবার সন্ধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন বাজেটের আকার, রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ, মূসক বিতর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: এবারের বাজেটের সম্ভাব্য যে অংক বলা হচ্ছে, তাকে কেউ কেউ উচ্চাভিলাষী বলছেন। আপনি এটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আমার বিবেচনায় বাজেটের এই আকার মোটেও বড় নয়। তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার যে বাজেটের কথা বলা হচ্ছে, তা জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে বাজেট হতে হবে জিডিপির কমপক্ষে ২০ শতাংশ।

সে হিসেবে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। তাছাড়া আমরা এখন ৭ শতাংশের উপরে জিপিডি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি। এখন কথা হচ্ছে, বাজেট মানেই চ্যালেঞ্জ…। আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। সেই আকাঙ্ক্ষা যাতে পূরণ হয়; বাস্তবায়ন হয়, সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে।

[ চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। দশ মাসের হিসাবে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে এনবিআর। সে কারণেই লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

পাশাপাশি মোট বাজেটের আকার সংশোধন করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী ]  

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটের কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন?

আমার বিবেচনায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর যদি রাজস্ব আদায় বাড়ানো না যায়, তাহলে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

তাই আমার পরামর্শ হচ্ছে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকার ও করদাতাদের মধ্যে যাতে উইন উইন সিচ্যুয়েশন হয়, সেই পথ অবলম্বন করতে হবে। ব্যক্তি খাতকে সম্পূর্ণ আস্থায় নিতে হবে। করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে; এভাবেই বাড়াতে হবে রাজস্ব।

আর এটা অবশ্যই সম্ভব এবং অবশ্যই হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।

এবার বাজেট ঘোষণার আগেই মূসক বা ভ্যাট নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক দেখা দিয়েছে।ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। আন্দালনের হুমকিও দিয়েছেন তারা।

বিষয়টি নিয়ে আমি ভেবেছি…। আমি মনে করি, মূল্য সংযোজন কর সম্পর্কে যে বিতর্ক রয়েছে, সেটার সমাধান এভাবে হতে পারে- পহেলা জুলাই ২০১৬ থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু করা যায়। তবে অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী, তাদের অনেকে ভালোভাবে হিসাব-নিকাষও রাখেন না, তাদের ক্ষেত্রে মূসকের হার এক বছরের জন্য ১৫ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ ধরা যেতে পারে।

মূসকের বড় ধরনের রাজস্ব ছাড়া এ বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে না। ২০০৯ সালে শুরু করা নতুন ভ্যাট আইন ২০১২ সালে সংসদে পাস হল। তারপর থেকেই এ বিষয়ে যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, তারই ধারাবাহিকতায় এর বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়ে সবাইকে একমত হতে হবে।

[চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের মধ্যে মূসক থেকেই সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৬৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।

নতুন অর্থবছরে মূসক থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু আদায় শুরুর আগেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ভ্যাট আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।]

১৬ কোটি মানুষের দেশে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) নাগরিকের সংখ্যা ১৮ লাখ। এর মধ্যে রিটার্ন দাখিল করেন বা কর দেন ১০ লাখেরও কম। তাহলে কীভাবে রাজস্ব বাড়বে?

এটা খুবই দুঃখজনক। হতাশাই বলব…। আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও নেপালের চেয়েও কম; ১০ ভাগের একটু বেশি। এটাকে বাড়তেই হবে; যে করেই হোক বাড়াতে হবে।

সে কারণেই আমার পরামর্শ হচ্ছে, প্রয়োজনে করের হার কমিয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে।

মূসক, আয়কর ছাড়া অন্য কোন কোন খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আসতে পারে বলে মনে করেন?

আমার বিবেচনায় আয়কর, শুল্ক, মূসক ছাড়াও রাজস্ব আদায়ের কতগুলো ভালো সূত্র আছে... যেমন- জ্বালানি তেল বিক্রি থেকে বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) যে উদ্বৃত্ত হয়, তার একটি বড় অংশ সরকারি কোষাগারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে একাধিক সংস্থার মাধ্যমে পেট্রোলিয়াম আমদানি ও বিপণন করা যেতে পারে। তবে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম আরও কমানোর ঘোষণা হলে তা ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।

আরেকটি বিষয় হল আমাদের ই-কর্মাস আজ রমরমা…। এতে যে ক্রয়-বিক্রয় হয় তার উপর কর ধরতে পারলে গরীব ও মধ্যবিত্তের কোনো ক্ষতি হবে না। সরকারের কোষাগারে জমা পড়বে বাড়তি অর্থ।

অর্থমন্ত্রী নতুন বাজেটে বড় প্রকল্পগুলোর জন্য আলাদা বরাদ্দ বা বাজেটের কথা বলছেন। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে পদ্মা সেতু, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ অগ্রাধিকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী এই বড় বড় প্রকল্পে আলাদা বাজেটের যে পরিকল্পনা করছেন, তা শুধু বাজেট নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই কল্যাণকর হবে বলে আমি মনে করি।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল। এই ধারা সামনের দিনগুলোতেও চলবে বলে মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন বাজেট বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কতোটা সম্ভাবনার পথ খুলবে বলে আপনি মনে করেন?

এখানে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা না করে পারছি না। তার সরকারের এই আট বছরে বাংলাদেশে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার মধ্যেও প্রবৃদ্ধির এই ধারা ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ। এখন আমরা ৭ শতাংশের ঘর আতিক্রম করছি…। এটাকে আমি শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্যই বলব…।

[২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্য হিসাব করে বলেছে, এবার ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। নতুন বাজেটে এই প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশই ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে।]

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্যের দাম কম। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?

আমি মনে করি, গতবারের মতেই এবার বেশ স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং খাদ্যপণ্যের দাম কম থাকার সুফল বেশ কিছু দিন ধরেই পাচ্ছে বাংলাদেশ। মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে তেল ও খাদ্যের কম দাম। সরকারের ভর্তুকির বোঝা অনেকটা কমেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনেক বাড়িয়েও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। এসব সুবিধা নতুন বাজেটেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে।

[২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এপ্রিল শেষে এই হার দাঁড়িয়েছে তারও কম; ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। নতুন বাজেটে মূলস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ] 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।