তার প্রস্তাব, ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রথম এক বছরের জন্য ১৫ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা যেতে পারে।
নতুন ভ্যাট আইন ২০১২ সালে সংসদে পাস হওয়ার পর এই বছরের ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা, যাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্দিষ্ট রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলে আসছিলেন, জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে কর আদায় করা হবে।
এর আগে ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রির উপর নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট না দিয়ে এককালীন একটি অঙ্ক ভ্যাট হিসেবে রাজস্ব বিভাগে জমা দিত।
১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়ের হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়বেন দাবি করে আগের মতো ‘প্যাকেজ ভ্যাট’ চালুর দাবি করে আসছেন তারা।
“তবে অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী-তাদের অনেকেই ভালোভাবে হিসাব-নিকাশও রাখেন না, তাদের ক্ষেত্রে মূসকের হার এক বছরের জন্য ১৫ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ ধার্য করা যেতে পারে।
“মূসক বা ভ্যাট সম্পর্কে যে বিতর্ক রয়েছে, সেটার সমাধান এভাবে হতে পারে।”
কয়েক বছর ধরেই রাজস্ব সংগ্রহে ভ্যাটকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে সরকার। নতুন বাজেটে এ নির্ভরতা আরও বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার মূল বাজেটের মধ্যে ভ্যাট বা মূসক থেকেই সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৬৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরে মূসক থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু তা আদায় শুরুর আগেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ভ্যাট আইন সংশোধনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, “মূসকের বড় ধরনের রাজস্ব ছাড়া এ বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে না। ২০০৯ সালে শুরু করা নতুন ভ্যাট আইন ২০১২ সালে সংসদে পাশ হয়। তারপর থেকেই এ বিষয়ে যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, তারই ধারাবাহিকতায় এর বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়ে সবাইকে একমত হতে হবে।”
অর্থমন্ত্রী শুরু থেকেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহালের পক্ষে দৃঢ়তা দেখিয়ে আসছিলেন। তবে সর্বশেষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনে ভ্যাট আইন সংস্কারের আহ্বানও জানান।
এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ ক্ষুদ্র ও খুচরা ব্যবসায় পর্যায়ে বিদ্যমান প্যাকেজ ভ্যাট বা মূসক ব্যবস্থা ২০২১ সাল পর্যন্ত বহাল রাখার দাবি জানান।
তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৮ হাজার টাকা; অন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৪ হাজার টাকা; জেলা শহরের পৌর এলাকায় ১০ হাজার টাকা এবং দেশের অন্য এলাকা ৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রেখেছেন।
তবে মুহিত বলছেন, “আমার নিজের প্রেফারেন্সটা হল, ওই ১৫ শতাংশ (ভ্যাট) রাখি, কিছুদিন রাখি, যাতে তারপরে উই ক্যান গ্রেইড আওয়ার প্রোডাক্টস।
“বিভিন্ন দেশে একের বেশি গ্রেড আছে। বৃটেনে যখন শুরু হলো তখন এটা প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ ছিল। এখন তো ২০ শতাংশ, ৩ শতাংশ, ২ শতাংশ, ১ শতাংশ সবই আছে। আমাদেরও সেই রকম হবে।”
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। বিদ্যুৎ বিলে যেমন খরচ বাড়বে, তেমনি পোশাক কিনতেও বাড়তি টাকা গুনতে হবে। এমনকি সাজগোজ করার জন্য গয়না কিনতেও বেশি ভ্যাট দিতে হবে।
এনবিআর মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার কথা বললেও সার্বিকভাবে পণ্য বা সেবামূল্যের ওপর প্রভাব ১ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। বিগত কয়েক বছরের গড়ে ৬ থেকে ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় আনলে তা অত্যন্ত নগণ্য বলে মনে করে এনবিআর।
ওই বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, নতুন মূসক আইন বাস্তবায়ন করলে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে মূসক আদায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে; আমদানি পর্যায়ে মূসক আদায় বাড়বে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
বর্তমানে বিদ্যুৎ বিলসহ ২০ ধরনের সেবার ওপর সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে বিভিন্ন হারে মূসক আরোপ করা আছে। এ হার ২ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। নতুন আইনে এসব খাতে অভিন্ন অর্থাৎ ১৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ করা হবে। ফলে ওই সব পণ্য ও সেবার পেছনে ক্রেতার খরচ বাড়তে পারে।
এনবিআর বলছে, নতুন আইন কার্যকর হলে আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয় পর্যায়সহ সব মিলে ১ হাজার ৯৭৩টি পণ্যের সব ধরনের মূসক অব্যাহতি সুবিধা উঠে যাবে। ফলে এসব পণ্যের ভোক্তা পর্যায়ে মূসক বাবদ করভার বাড়বে। এর মানে, ভোক্তাকে আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হবে, বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে।
সব মিলে ট্যারিফ লাইনের ৭৪ দশমিক ৪ ভাগ পণ্যে সরাসরি ১৫ শতাংশ মূসক আরোপ হবে।
বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৮৫টি পণ্যের ওপর ট্যারিফ মূল্য ধরে মূসক আরোপ করা আছে। অর্থাৎ ওই পণ্যগুলোর পরিমাপের এককের ওপর মূসক নির্ধারিত আছে। ১৫ শতাংশ হার কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে এমএস রডের বাজারে।
বর্তমানে ট্যারিফ মূল্যভিত্তিক ব্যবস্থায় রড কিনতে টনপ্রতি ৪১২ টাকা ৫০ পয়সা মূসক পরিশোধ করতে হয়। নতুন আইনে বিভিন্ন পর্যায়ে রেয়াত নেওয়ার পরও বর্তমান বাজারদরে প্রতি টনে ৩ হাজার ২২৯ টাকা মূসক পরিশোধ করতে হবে। এতে টনপ্রতি এমএস রডের বাজারদর টনে ২ হাজার ৮১৬ টাকা বাড়বে বলে এনবিআর বলছে।
শুধু রড নয়, নতুন মূসক আইন কার্যকর হলে নির্মাণ ব্যয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। ইট ও বালু কিনতে খরচ বাড়বে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, এসব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ মূসক কার্যকর হবে। এর ফলে বেসরকারি নির্মাণ খাতের পাশাপাশি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে পারে।
ব্র্যান্ডের দোকানগুলো থেকে পোশাক কিনতে গেলে ক্রেতাদের এখন মোট মূল্যের ওপর ৪ থেকে ৫ শতাংশ মূসক দিতে হয়। ১৫ শতাংশ মূসক বসলে একটি জামার দাম ২০০০ টাকা হলে ক্রেতাকে বাড়তি ২০০ টাকা গুনতে হবে।
নতুন মূসক আইন বাস্তবায়িত হলে খরচ বাড়বে সোনা ও হীরার গয়না কিনতেও। গয়নার ওপর এখন ৫ শতাংশ মূসক আরোপ করা আছে; যা ১৫ শতাংশ হলে ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার গয়না কিনতে ৪ হাজার টাকার মতো খরচ বাড়বে।
নতুন মূসক আইনে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মূসক অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে মৌলিক খাদ্য, নির্ধারিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহনসেবা, গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি, মৎস্য চাষ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবা—এসব ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।