লোপাট ৮ কোটি ডলারের অর্ধেক জুয়ার টেবিলে

হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপিন্সে গেছে তার মধ্যে ৪৬ মিলিয়ন ডলার দেশটির ক্যাসিনোতে জুয়ার টেবিলে বৈধ হওয়ার তথ্য পেয়েছে নজরদারির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থা অ্যামিউজমেন্ট গেমিং করপোরেশন বা প্যাগকর।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2016, 04:24 PM
Updated : 11 March 2016, 04:39 PM

এ সংস্থার কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ফিলিপিন্সের ডেইলি ইনকোয়ারার জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে প্রায় ২০ দিন জুয়ার টেবিলে ওই অর্থ ঘোরাফেরা করেছে। বাকি টাকা অন্য কোনোভাবে দেশটি থেকে পাচার হয়ে গেছে বলে কর্মকর্তাদের ধারণা।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে সরানো বাংলাদেশের টাকা ফিলিপিন্সের যে ব্যাংকে প্রথম গিয়েছিল সেই রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্যবস্থাপকের দেশছাড়ার চেষ্টা শুক্রবার আটকে দিয়েছে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।

ব্যবস্থাপক মাইয়া সানতোস দেগুইতোকে বিমানবন্দর থেকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে ইনকোয়ারারের খবর।

ব্যাংকের টাকা চুরির যেসব ঘটনা এ পর্যন্ত বিশ্বে ঘটেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ঘটনাকে ‘অন্যতম বড়’ জালিয়াতির ঘটনা বলা হচ্ছে।

ওই ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ফায়ারআইয়ের ম্যানডিয়েন্ট ফরেনসিক বিভাগের সহযোগিতা নেওয়া নিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।                        

গত মাসে সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) মেসেজিং সিস্টেমে জালিয়াতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে ভুয়া নির্দেশনা পাঠিয়ে বাংলাদেশের প্রায় এক বিলিয়ন টাকা সরানোর চেষ্টা হয়।

এরমধ্যে ৮১ মিলিয়ন ডলার যায় ফিলিপিন্সের আরসিবিসির পাঁচটি অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে স্থানীয় মুদ্রা পেসোতে রূপান্তরের পর ওই টাকার একটি অংশ চলে যায় দুটি ক্যাসিনোতে। জুয়ার টেবিলে আয় বৈধ করার সুযোগ নিয়ে হাতবদলের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায় ওই টাকা।

ফিলিপিন্সের ইনকোয়ারার পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন হলে গত সপ্তাহে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।

এছাড়া আরেক ভুয়া আদেশে শ্রীলঙ্কার একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর অ্যাকাউন্টে ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হলেও বানান ভুলে সন্দেহ জাগায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।

প্যাগকরের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে শুক্রবার পত্রিকাটি জানায়, ফিলিপিন্সে যাওয়া ৮১ মিলিয়নের ৫৬ শতাংশ, অর্থাৎ ৪৬ মিলিয়ন ডলার দুটি ক্যাসিনোর মাধ্যমে হাতবদল করা হয়েছে।

এর মধ্যে দেশটির ক্যাগায়ান প্রদেশের সোলায়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনোর মাধ্যমে ২৬ মিলিয়ন ডলার এবং ইস্টার হাওয়াই ক্যাসিনো অ্যান্ড রিসোর্টের মাধ্যমে ২০ মিলিয়ন ডলার ৫ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ফিলিপন্সের আর্থিক ব্যবস্থায় মিশে যায়।

ফিলিপিন্সের ক্যাসিনোগুলোতে আর্থিক লেনদেনের নজরদারির কাজটি করে থাকে প্যাগকর।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্যাগকরের এক কর্মকর্তা ইনকোয়ারারকে বলেন, “হ্যাকিং করে আনা অর্থের একটি অংশ স্থানীয় ক্যাসিনোগুলোর জুয়ার টেবিলে চিপস কিনতে ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি অর্থ ক্যাসিনোগুলোতে একেবারেই আসেনি; আমরা জানি না সেগুলো কোথায় গেছে।”

পত্রিকাটি লিখেছে, বড় জুয়াড়িদের জন্য ক্যাসিনোগুলোয় বাকিতে চিপস কেনার সুবিধা রয়েছে। রিজল ব্যাংকের সেই সন্দেহভাজন অ্যাকাউন্টের টাকা জুয়াড়িদের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার আগেই বাকির সুবিধা নিয়ে তারা খেলতে শুরু করেছিলেন।

ফিলিপিন্সের আইন অনুযায়ী ক্যাসিনোতে জুয়ায় জেতা অর্থ থেকে নির্ধারিত ট্যাক্স দিলে তা বৈধ আয় বিবেচিত হয়।

ওই কর্মকর্তা বলেন, “বাংলাদেশের ওই অর্থ প্রায় ২০ দিনের মতো জুয়ার টেবিলে বাজি ধরতে ব্যবহার করা হয়েছে। তখন সবকিছুই খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে। ”

ইনকোয়ারারের প্রতিবেদন প্রকাশের পরই কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে শুরু করে।

ফিলিপিন্সের এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) তদন্তে নামার পর তাদের অনুরোধে দেশটির একটি আদালত ১ মার্চ ওই অর্থ আটকানোর আদেশ দেয়। তবে ততদিনে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

ওই আদেশে চুরি যাওয়া অর্থের কতটা এএমএলসি জব্দ করতে পেরেছে, আর কতটা বাংলাদেশকে ফেরত দেওয়া সম্ভব তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে ইনকোয়ারার জানিয়েছে।

এদিকে রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্যবস্থাপক মাইয়া সানতোস দেগুইতোকে শুক্রবার নিনয় অ্যাকুইনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করেছে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।

ইনকোয়ারার জানায়, ফিলিপিন্স এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে জাপানের নারিতায় যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা। রিজলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ‘ব্যাংকে মুদ্রাপাচার ও জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধ ম্যানুয়াল’ ভাঙার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

এর আগে এএমএলসি রিজলের ওই পাঁচ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের টাকা লেনদেনে ছয়জনের সংশ্লিষ্টতা পায়। পরে স্থানীয় একটি আদালত ওই সব অ্যাকাউন্ট ছয় মাসের জন্য জব্দ করার আদেশ দেয়।

আরসিবিসিতে ওই পাঁচটি অ্যাকাউন্ট গত বছরের মে মাসে মাত্র ৫০০ ডলার রেখে খোলা হয়। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অর্থ স্থানান্তরের আগে আর কোনো লেনদেন সেগুলোতে হয়নি।