‘ব্যাংক সুদ হার কমাতে ভালো উদ্যোক্তা দরকার’

ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমানোর জন্য উদ্যোক্তাদের ভালো ঋণ গ্রহীতা হিসেবে প্রমাণ করা ছাড়াও বেশ কয়েকটি শর্তের কথা বলেছেন দেশের শীর্ষ ব্যাংকাররা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2015, 07:52 PM
Updated : 27 Nov 2015, 07:52 PM

তাদের অন্য শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, খেলাপি ঋণ কমানো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমার সিআরআরের অংশ কমানো এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানো।

বেশি মুনাফা পেতে আমানতকারীদের ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের পরামর্শও দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ১১টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

শুক্রবার বিকালে ব্যাংকার-গ্রাহক প্রশ্নোত্তর বিষয়ক এক সংলাপ অনুষ্ঠানে এ অভিমত দেন তারা।

রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে চলমান ব্যাংকিং মেলার চতুর্থ দিনে এ আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাড়ে তিন ঘণ্টার এই আলোচনার সিংহভাগ সময়ই কেটেছে গ্রাহকদের বিভিন্ন প্রশ্ন ও তার উত্তরে।

একাডেমির মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি শুরু হয় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের পরিচয় এবং তাদের ব্যাংকের কর্মকাণ্ড ও পরিধি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। এরপরই চলে আসে গ্রাহকদের সরাসরি প্রশ্ন পর্ব।

প্রথমে আলোচিত বিষয় ঋণের উচ্চ সুদ হার বিষয়ক প্রশ্নের মুখোমুখি হন ব্যাংকাররা।

এছাড়া ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা, আমানতের সুদ হার, নিয়োগ পদ্ধতি, ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা, জাল-জালিয়াতি, ব্যাংকারদের কর্মঘণ্টাও চলে আসে একের এক প্রশ্নে।  

প্রথম প্রশ্ন করেন মো. আকতারুজ্জামান, যিনি নিজেকে একটি ফিড মিলের মালিক বলে পরিচয় দেন।

আকতারুজ্জামান বলেন, “ঋণ নিয়ে ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রধান বাধা উচ্চ সুদ হার। কবে নাগাদ ঋণের সুদ হার এক অংকের ঘরে নেমে আসবে?”

একজন নারী উদ্যোক্তা জানতে চান, তাদের জন্য ঋণের সুদ হার ১০ শতাংশের নীচে নামানো যাবে কি না।

উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে এই প্রশ্নে সমর্থন জানানোর মধ্যে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিক বিরুপাক্ষ পাল প্রশ্নের জবাব দিতে সোনালী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিদার মো. আব্দুর রউফকে অনুরোধ করেন।

রউফ বলেন, “সোনালী ব্যাংকের ৮১ হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে। এরমধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, যার একটি বড় অংশ কৃষি খাতের ঋণ। এসব ঋণের সুদ হার ১০ শতাংশের নীচে। ৩৪ হাজার কোটি টাকা সরকারের বিভিন্ন বিল বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আমরা ঋণ দিতে পারছি না। অভিঘাত হচ্ছে। তবে এখন সুদ হার কমছে।”

এরপরে জবাব দেন এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম হাফিজ।

তিনি বলেন, “কম সুদে ঋণ পেতে হলে ভালো উদ্যোক্তা হতে হবে। ব্যাংক তার টপ লাইন ব্রোয়ারের জন্য কম সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। সেখানে ঝুঁকি কম। সুদ হার নির্ধারণে ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়। ব্যাংকের ঝুঁকি কম হলে কম সুদ নেওয়া সহজ। এছাড়া খেলাপি ঋণও সুদ হার বাড়িয়ে থাকে। এজন্য খেলাপি ঋণও কমাতে হবে।”

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালামও ভালো উদ্যোক্তার কথা বলেন।

“আমরা ঋণ দেই জনগণের থেকে টাকা নিয়ে। সে টাকা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু আমরা ভালো উদ্যোক্তা পাই না। আবার আরেক সমস্যা হচ্ছে, অনেকেই ব্যবসার শুরুতে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চায়। আমরা চাই ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে একজন গ্রাহক নিজেকে ভালো গ্রাহক হিসেবে প্রমাণ করবে,” বলেন তিনি।

এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হায়দার আলী মিঞা বলেন, “রপ্তানি খাতে ৭ শতাংশ সুদে অর্থায়ন করছে ব্যাংক। এখন বাজারে অতিরিক্ত তারল্য আছে। অন্যান্য খাতেও সুদ হার সহসাই কমে আসবে। তবে এজন্য আমানতের সুদ হার কমতে হবে।”

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হামিদ বলেন, “ব্যাংক ৭ শতাংশ সুদে আমানত নেওয়ার পর তা থেকে সিআরআর ও এসএলআর রেখে ঋণ বিতরণ করতে হয়। ফলে চাপটা বেশি। এজন্য আমি বলবো সিআরআর ও এসএলআরের মডেলে পরিবর্তন এনে সিআরআর কমানোর জন্য। কারণ সিআরআর এ ব্যাংক কোনো মুনাফা পায় না। কিন্তু এ খাতে আমানতের একটি অংশ চলে যায়।”

সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানোরও পরামর্শ দেন তিনি।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ করে শিল্পায়নের জন্য ঋণের সুদ হার কমানো দরকার বলে উপস্থিত সব ব্যবস্থাপনা পরিচালক মত দেন।

ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, “দেশ গঠনের জন্য ঋণের সুদ হার কমাতে হবে। আমানতের সুদ হার নির্ধারণ হয় ঋণের সুদ হার ভিত্তি করে। এজন্য আমি পরামর্শ দিব বেশি মুনাফার জন্য মিউচুয়াল ফান্ড, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার।”

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট এখনও ডেভেলপ করেনি। আমি মনে করি, সঞ্চয়কারীরা এ খাতে বনিয়োগ করতে পারে।”

খুলনার ফুলতলার জসিম ফরাজী বলেন, “আমি ডেইরি ফার্ম করি। যুব উন্নয়ন থেকে আমার প্রশিক্ষণ আছে। কিন্তু কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছি না।”

একই অভিযোগ করেন নোয়াখালীর সূবর্ণচরের আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। মাহমুদ কারখানা স্থাপন করলেও চলতি মূলধনের অভাবে সেটি চালাতে পারছেন না। সূবর্ণচর প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ট্যুরিজম ব্যবসায়ী সাইফুলও ব্যাংক ঋণ না পাওয়ার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, “আমি পাঁচ বছর ধরে ব্যবসা করছি। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে আমার হিসাব আছে, ক্রেডিট কার্ড আছে। কিন্তু ব্যাংক আমাকে ব্যবসায়ী ঋণ পাওয়ার জন্য যোগ্য মনে করে না।”

তিনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতার যোগ্যতা জানতে চান।

উত্তরে ব্যাংকটির এমডি এনামুল হক বলেন, “একেকটি ব্যাংকের একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য। একেকভাবে হিসাব করে।”

অনুষ্ঠানের শেষভাগে আসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান। তিনি কয়েকজন গ্রাহকের প্রশ্ন শোনেন।

সমাপনী বক্ততায় গভর্নর বলেন, “পশ্চিমের ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমাদের ব্যাংকগুলো গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আছে। এরপরও আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র খুলেছি। সেখানে প্রতিদিন অভিযোগ আসে, আমরা এবছরও ৩ হাজারের বেশি অভিযোগ পেয়েছি। এরমধ্যে ৯৯ ভাগের বেশি নিষ্পত্তি করা হয়েছে।”

আতিউর রহমান বলেন, “বাংলাদেশের মত দেশে শুধু ব্যাংকগুলো সাধু হবে আর অন্য সবাই যার যার জায়গায় থাকবে- এটা হবার নয়। কারণ একটা আরেকটার সাথে জুড়ে আছে। তারপরও ব্যাংকিং খাত অনেক শৃংখল ও জবাবদিহির মধ্যে আছে।

“আশাকরি ব্যাংকগুলোর যে ঘাটতি আছে তা পূরণের চেষ্টা করবে।”

ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষায় ফিস নেওয়া বন্ধ করার আহ্বান জানান গভর্নর।

ভালো উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান গভর্নর।

“বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা ১০ হাজার জনকে উদ্যোক্তা হবার প্রশিক্ষণ দেব,” বলেন তিনি।

ব্যাংকারদের মত গভর্নরও মনে করেন, খেলাপি ঋণের হার কমানো না গেলে ঋণের সুদ হার কমানো যাবে না। এজন্য ভালো উদ্যোক্তার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম, আবু হেসা মো. রাজী হাসান, আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারোয়ার, মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল আমীন বক্তব্য রাখেন।