টাকার মান কমছে প্রতিদিনই

এক মাসের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ দর হারিয়েছে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকা। তবে এতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই বলে মনে করছেন গবেষকরা।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2015, 06:57 AM
Updated : 19 Nov 2015, 06:57 AM

তারা বলছেন, টাকার মান কমার এই প্রবণতা রেমিটেন্স ও রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য ভালো।

গত ১৫ অক্টোবর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক মার্কিন ডলারের জন্য ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা খরচ করতে হয়। বুধবার সেই এক ডলারের জন্য ৭৮ টাকা ৭৭ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। অর্থ্যাৎ, এই এক মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার দর প্রায় এক টাকা কমেছে।

ভারতের মুদ্রা রুপি, চীনের ইউয়ান, রাশিয়ার রুবল ও ইউরো জোনের ইউরোর যখন বড় দরপতন হয় তখন টাকার মান ‘স্থিতিশীল’ ছিল, কোনো ‘নড়াচড়া’ করেনি। এখন ওইসব মুদ্রার মান ‘স্থিতিশীল’ হলেও ডলারের বিপরীতে ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এখন প্রতিদিনই প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার দর ৭ থেকে ১০ পয়সা করে কমছে।

কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দর ৮২ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক সোমবার ৭৯ টাকা ২০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। বিদেশি ব্যাংক এইচএসবিসি বিক্রি করেছে আরও বেশি দরে- ৮০ টাকা ৮৫ পয়সায়।

নয় মাস প্রতি ডলার ৭৭ টাকা ৮০ পয়সায় স্থির থাকার পর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে একটু ‘নড়াচড়া’ শুরু করে।

রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে কিছুটা ভাটা পড়ায় বাজারে চাহিদা বাড়াকে ডলারের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান।

‘এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই’ উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজারে ডলারের কোনো ঘাটতি নেই। সোমবারও আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ৭৫ থেকে ৭৬ মিলিয়ন ডলার ট্রেড হয়েছে। ভারত, চীন, রাশিয়া ও ইউরো জোনের মুদ্রার যখন দরপতন হচ্ছিল, তখন কিন্তু টাকা শক্তিশালী ছিল। এখন ডলারের চাহিদা বাড়ায় কিছুটা দুর্বল হচ্ছে।

“আমাদের হাতে পর্যাপ্ত রিজার্ভ আছে। প্রয়োজন পড়লে সেখান থেকে আগের মতো বিক্রি করা হবে।”

তবে টাকার মান কমার এই প্রবণতাকে রেমিটেন্স ও রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক মনে করেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন,“বাজার থেকে ডলার কিনে এক ধরনের হস্তক্ষেপ করে এতদিন ডলার-টাকার বিনিময় হার স্থির রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কেউ আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছেন না।

“দাম আরও বাড়তে পারে- সে আশায় সবাই ডলার আটকে রাখছেন। আর সে কারণেই দাম বাড়ছে।”

ডলারের চাহিদা কেন বাড়ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বিআইডিএসের এই গবেষক বলেন, জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্য আমদানিতে খরচ কমলেও সরকারের বড় বড় প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানির খরচ বাড়ছে।

“এছাড়া অন্যান্য দেশের মুদ্রার মান পড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ও কম আসছে। রেমিটেন্স প্রবাহেও ধীর গতি। সবকিছু মিলিয়েই বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে।”

তবে এতে উদ্বেগের কোনো কারণ দেখছেন না জায়েদ বখত।

“প্রচুর রিজার্ভ আছে। কোনো অসুবিধা হবে না; বরং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের জন্য ভালো হবে।”

২৯ অক্টোবর প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন (রিজার্ভ) ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ৯০ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর তা কমে এসেছে।

সোমবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।

এই রিজার্ভ উৎপাদনশীল খাতে ‘কাজে আসছে না’ বলে অনেক অর্থনীতিবিদ তা নিয়ে অতটা উচ্ছ্বসিত নন।

জায়েদ বখত মনে করেন, বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়া দরকার।

চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৫০২ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ১৬ শতাংশ কম।

তবে এই চার মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার, যা প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশ।

ডলার শক্তিশালী হওয়ায় আগে প্রবাস থেকে পাঠানো মুদ্রা ভাঙিয়ে যে টাকা পাওয়া যেত, এখন তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। আবার পণ্য রপ্তানি করে পাওয়া ডলারের মূল্যমানও বেশি হবে বাংলাদেশি টাকায়।

টাকা শক্তিশালী থাকা অবস্থায় রপ্তানিকারকদের তুলনায় আমদানিকারকরা বেশি লাভবান হচ্ছিলেন। কারণ টাকার মূল্যে হিসাব করলে সব পণ্যের আমদানি খরচ কম পড়ছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, ২০১২ সালে ডলারের দর বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে এক ডলার কিনতে ৮৫ টাকা লাগত।

তিন বছরে সেই ডলারের দর পড়তে পড়তে গত বছরের অগাস্টে ৭৭ টাকা ৪০ পয়সায় নেমে এসেছিল।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি ডলার ৭৭ টাকা ৮০ পয়সায় স্থির ছিল।

রপ্তানি বাড়াতে সম্প্রতি চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না চীনা মুদ্রা ইউয়ানের বিনিময়মূল্য বেশ খানিকটা কমিয়েছে। তার আগে রুপি, রুবল এবং ইউরোরও দরপতন হয়।

বাংলাদেশে অর্থনীতিবিদরা রপ্তানি ও রেমিটেন্স বাড়াতে বিভিন্ন সময়ে টাকার মান কমানোর পরামর্শ দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাড়া দেয়নি।

এখন সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এক মাসেরও বেশি সময় বাজার থেকে কোনো ডলার কেনেনি তারা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ছাইদুর রহমান বলেন, “এখন আর কেউ ডলার বিক্রি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসছে না। সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর আমরা ডলার কিনেছিলাম।”

চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট ১৭৫ কোটি ( ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন) ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩৪০ কোটি (৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগের বছরে (২০১৩-১৪) কেনা হয় ৫১৫ কোটি ডলার।

২০০৩ সালে বাংলাদেশে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা (ফ্লোটিং) চালু হয়। অর্থ্যাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে টাকা-ডলারের বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করেছে।

২০০৩ সালের আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার-টাকার বিনিময় হার ঠিক করে দিত। সে দরেই ডলার লেনদেন হত।