ব্যাংকের সিএসআরের অর্থে ‘উন্নত’ ভবিষ্যতের পথে

সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে একটি ব্যাংকের দেওয়া অর্থে চলছে দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসা-শিক্ষা, যাতে প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে মূলধারার শিক্ষায় ঢুকছে অনেকে।

শেখ আব্দুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2015, 07:43 PM
Updated : 29 Sept 2015, 07:43 PM

বাক প্রতিবন্ধী শিশুর মুখে কথা ফুটে হাসির রেখা ছড়াচ্ছে বাবা-মায়ের মুখে। স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা আর শিক্ষকদের পরামর্শ-শিক্ষায় ক্রমশ উন্নতির দিকে চলছে শত শত প্রতিবন্ধী শিশু।

রাজধানীতে দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কর্মরত এই প্রতিষ্ঠান সিড ট্রাস্ট। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুদানের অর্থে প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে কাজ করছে তারা।

ঢাকার মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ ও রায়েরবাজারে তিনটি কেন্দ্র্রে ৪৫০ জন প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকে সিড ট্রাস্ট। প্রতিবন্ধী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষা দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।

ট্রাস্টটির এসব কেন্দ্র পরিচালনায় বছরে অন্তত দুই কোটি টাকা খরচ হয়, যার অন্যতম যোগানদাতা হিসেবে কাজ করছে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড। প্রতিবছর সিএসআর তহবিল থেকে তাদের ১২ লাখ টাকা করে অনুদান দিচ্ছে ব্যাংকটি।

সিড ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক দিলারা সাত্তার মিতু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের কাজে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সহায়তার হাত বাড়িয়েছে।

“এরমধ্যে ঢাকা ব্যাংক শুরু থেকেই আমাদের পাশে আছে। ক্রমান্বয়ে সহায়তার পরিমাণ বাড়ছে। ঢাকা ব্যাংক পাশে থাকায় অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান সহজে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।”

লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিবন্ধী শিশুদের সমাজের সাথে খাপ খাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলা এবং তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলে সিড ট্রাস্ট।

লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন স্কুল ড্রেস, যাতায়াত সুবিধা, ফিজিওথেরাপি, দুপুরের খাবার এবং শোনা, দেখা ও চলার সহায়ক উপকরণ, রেফারেল চিকিৎসা সেবা ইত্যাদি দিয়ে থাকে তারা।

প্রতিবন্ধী শিশুরা লেখাপড়ার পাশপাশি হাতে ও মেশিনে সেলাই, ব্লক, বুটিক, ডাই টাই, মোম বানানো ও ছবি আঁকা শিখছে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগও হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুদের।

আবার অনেকে লেখাপড়ায় ভালো করে চলে যাচ্ছে মূল ধারার স্কুলে। তাদেরই একজন তানিয়া। তার বয়স ১৪ বছর। বাড়ি কামরাঙ্গীর চরের নূরবাগে। এ বছর সে স্থানীয় শিশুকল্যাণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।

মেয়েটি বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিল। একবছর বয়সে তানিয়া ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে আনা হয়। ডায়রিয়া থেকে সুস্থ হলেও নতুন সমস্যা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানকার চিকিৎসক ফিজিওথেরাপি গ্রহণের পরামর্শ দেন।

কিন্তু দরিদ্র বাবা আকবর মৃধা ও মা নাসিমা আখতার মেয়ের চিকিৎসা করাতে যাননি। ধীরে ধীরে স্থায়ী প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে তানিয়া।

২০০৯ সালে সিড ট্রাস্ট মেয়েটিকে তাদের মোহাম্মাদপুরের হুমায়ুন রোডের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। তানিয়ার মাকেও এই কেন্দ্রে সহায়তাকারী হিসেবে একটি কাজের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর কেন্দ্রের ফিজিওফেরাপিস্ট, শিক্ষকসহ অন্যদের সেবায় তানিয়া ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

২০১৪ সালের শেষদিকে এসে তানিয়া নিজের মত করে চলতে ও পড়তে শেখে। এরপর সিড ট্রাস্ট তানিয়াকে মূলধারার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়।

একইভাবে তাদের সহায়তায় রায়েরবাজার বস্তির প্রতিবন্ধী ফিরোজও মূলধারার স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে।

এক সময় কথা বলতে ও হাঁটতে পারত না ফিরোজ, তার ডান হাতও কাজ করত না। ২০০৫ সালে সিড ট্রাস্টে আসার পর তার অস্ত্রোপচার ও অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়া হয়। এখন সে কথা বলতে ও হাঁটতে পারে। বুদ্ধিমত্তার উন্নতিও হয়েছে তার।

সিড ট্রাস্ট থেকে প্রি-প্রাইমারি শিক্ষা নিয়ে সে রায়েরবাজার ছিন্নমূল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। গত বছর ফিরোজ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করে।

এই কেন্দ্রের ফিজিওথেরাপিস্ট এএনএম মঈদুল ইসলাম বলেন, “গর্ভাবস্থায় বা জন্মের সময় কিছু সমস্যার কারণে শিশুরা প্রতিবন্ধী হয়। এরমধ্যে কিছু বিষয় পরবর্তীতে ঠিক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এখানে সেই বিষয় নিয়ে চেষ্টা করা হয়।

“এতে অনেক শিশুর উন্নতি হচ্ছে। অনেকে একেবারেই নিজের হাতে কিছু ধরতে পারত না, এখন লিখতে পর্যন্ত পারছে। আবার অনেকের জিহ্বার আড়ষ্টতার কারণে কথা বলতে পারত না, এখন কিছু কিছু কথা বলছে।”

চার বছর ধরে কাজ করা এই ফিজিওথেরাপিস্টের কথার প্রমাণ পাওয়া গেল প্রতিবন্ধী মেহেদী হাসানের মা মমতাজ বেগমের কথায়।

মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের এই বাসিন্দা বলেন, “আমার ছেলের বয়স ১২ বছর। সে ১১ বছর পর্যন্ত বাবা, মা বা অন্য কোনো শব্দ স্পষ্ট করে বলতে পারত না। শুধু শব্দ করে ইঙ্গিতে বোঝাত। এখান সে আব্বু, আম্মু, দাদু, আপু, খাব, যাবসহ বেশ কয়েকটি শব্দ বলতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানের দুই বছরের চেষ্টায় এতটুকু হয়েছে।”

এই কেন্দ্রে ছয়জন শিক্ষক, একজন ফিজিওথেরাপিস্টসহ মোট ১৭ জন কাজ করছেন।  তাদের তিনটি কেন্দ্রে বিভিন্ন স্তরে এমন অর্ধশতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

সিড ট্রাস্ট পরিচালিত মোহাম্মাদপুর হুমায়ুন রোডের কেন্দ্রে ১৫০ জন ছেলে-মেয়ে প্রাণবন্ত পরিবেশে লেখাপড়া ও হাতের কাজ শিখছে। এখানে চারটি ধাপে শিশুদের বিশেষ প্রি-প্রাইমারি শিক্ষা দেওয়া হয়।

প্রথম ধাপ কুসুমকলি-এখানে কিছু শেখানো হয় না। শুধু প্রতিবন্ধী শিশুদের ধরণ বোঝা হয়। শিশুটি কোন ধরনের প্রতিবন্ধী (শারীরিক, মানসিক, অটিজম) তা নির্ণয় করা হয়।

সেখান থেকে বুঝতে, পড়তে বা কাজ শিখতে সক্ষম শিশুদের নিয়ে আসা হয় পরের ধাপ অপরাজিতায়।

তৃতীয় ধাপ গোলাপ- এখানে শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক ও বিশেষায়িত শিক্ষা দেওয়া হয়। শেষ ধাপ অঞ্জলীতে শিশুরা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। 

এ বিষয়ে ঢাকা ব্যাংকের হেড অব ব্র্যান্ডিং আনোয়ার এহতেশাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা ব্যাংক সিএসআরের অর্থ মানবিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করতে চায়। সেই চিন্তা থেকেই সিড ট্রাস্টের কার্যক্রমে সহায়তা করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলার সুযোগ হলে তারা সমাজের বা পরিবারের বোঝা হবে না, বরং সমাজের কল্যাণে আসবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, “সিএসআরের অর্থ ব্যাংক কোথায় কিভাবে ব্যয় করবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নীতিমালা দিয়েছে।শিক্ষা খাতে ৩০ শতাংশ সিএসআরের অর্থ বরাদ্দ করার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। কারণ শিক্ষার উন্নয়ন করা গেলে সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন হবে। সিএসআরের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা।

“প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে ব্যাংক সিএসআরের অর্থ ব্যয় করলে সেটা অবশ্যই ইতিবাচক। কারণ প্রতিবন্ধী শিশুরা পরিবারের জন্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধী শিশু কিছুটা হলেও আত্মনির্ভরশীল হতে পারলে সেটা ইতিবাচক।”