মানুষকে সন্তুষ্ট করুন, নইলে খবর আছে: সরকারি চাকরিজীবীদের দুদক কমিশনার

দুই মাসের মধ্যে সেবা প্রার্থী চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ ‘সন্তুষ্ট’ না হলে সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘খবর আছে’ বলে হুঁশিয়ারি করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার নাসির উদ্দিন আহমেদ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 August 2017, 10:15 AM
Updated : 24 August 2017, 02:20 PM

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ‘গণশুনানি বিষয়ক মত বিনিময়’ সভায় অতিথির বক্তব্যে এ হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, লোহাগাড়াসহ কয়েকটি উপজেলায় ইতোপূর্বে হওয়া দুদকের গণশুনানি বিষয়ে মত বিনিময় করতে এ সভার আয়োজন করা হয়।

যৌথভাবে সভার আয়োজন করে দুদক, সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগর।

সভায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পল্লী বিদ্যুৎ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার বিষয়ে অভিযোগ করেন সনাক, টিআইবি এবং চট্টগ্রাম মহানগর দু্র্নীতি প্রতিরোধ কমিটির নেতারা।

সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তারা উত্তরও দেন।

সবশেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুদক কমিশনার নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, “নভেম্বর মাসে সময় নিয়ে চট্টগ্রামের অফিসগুলো ভিজিট করব। শুরু করব মেডিকেল কলেজ দিয়ে। সেখানে সাধারণ মানুষের চলাচল বেশি।

“ওয়াসা বা আরও কিছু জায়গায় যেখানে সাধারণ মানুষের অংশীদারিত্ব আছে সেখানে যাব। কাস্টমস বা ট্যাক্সে এখন যেতে চাই না। সেখানে সাধারণের সম্পৃক্ততা তুলনামূলক কম।”

দুদক কমিশনার বলেন, “চট্টগ্রাম মহানগরে বিদ্যুতের অবস্থা এখনো সন্তোষজনক নয়। অনেক গ্রে এরিয়া আছে। আমরা ঘরে ঘরে যাব। সেম্পলিং করে দেখব। সে যেই হোক, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে কি না দেখব।

“রেন্ডম সেম্পলিং করতে জনগণের কাছে যাব। জনগণ সন্তুষ্ট হলে আমরাও সন্তুষ্ট। সাধারণ মানুষ যদি সন্তুষ্ট না হয় তাহলে আপনাদের খবর আছে। অল্প কিছু এক্সাম্পলারি পানিশমেন্ট (দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি) যদি হয়, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”

তিনি বলেন, “সরকারি অফিসে হাসি মুখ খুব কম দেখি। জানি কাজের খুব চাপ। কিন্তু জনগণের সাথে ভালো আচরণ করুন। আমরা উল্টো চোখ রাঙানি দিই। কিন্তু যখন পদে থাকবেন না, তখন কি হবে?

“একজন উচ্চ পদস্থ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাকে আমি চিনি। তিনি বললেন, অবসরের পর বুঝি আসলে টাকা দিয়ে কাজ করাতে হয়।”

সরকারি অফিসে সক্রিয় দালালদের তালিকা করে দুদককে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংস্থাটির কমিশনার।

সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে নাসির উদ্দিন বলেন, “দালালদের তালিকা করুন। কিছু রিস্ক আছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ার অসুবিধা থাকলে গোপনে আমাদের দেন। আপনাদের নিয়োগ-পদোন্নতির অসুবিধা আছে, আমাদের নেই।

“পলিটিক্যাল বিষয়… যদি মনে করেন হ্যান্ডেল করা ডিফিকাল্ট, আমাদের দেন; সে যত বড়ই হোক ব্যবস্থা নেব। আইসিটি অ্যাক্ট অনুসারে কথা যদি মোবাইলে রেকর্ড করেন সেটাও এভিডেন্স। গোপনে রেকর্ড করে আমাদের দিন।”

সভায় দুদক কমিশনার সরকারি কর্মকর্তাদের ১৫ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।

এর মধ্যে আছে হেল্প ডেস্ক চালু, দপ্তর প্রধানদের সাথে সেবাগ্রহীতাদের সরাসারি কথা বলার ব্যবস্থা করা, প্রতি সপ্তাহে গণশুনানির ব্যবস্থা করা, তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ, ইউনিয়ন পর্যায়ে সিটিজেন চার্টার টাঙ্গানো, সিটিজেন রিপোর্ট কার্ড চালু করা, মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেবা প্রদান ইত্যাদি।

‘ভূমিকম্প হয়ে যাবে, দপ্তরগুলো বদলাবে না’

চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের দেখা না পাওয়া এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেবা বিষয়ে অভিযোগ করেন দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য এ বি এম খালেকুজ্জামান।

সভায় তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পরিবেশ অমানবিক। সেখানে রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়।

“ময়ল আর্বজনা এবং অব্যবস্থাপনা চরমে। সেখানে মানুষও থাকে, কুকুরও থাকে। কুকুরের সাথে ভালো ব্যবহার করে, মানুষের সাথে না।”

এ বি এম খালেকুজ্জামান বলেন, “নিজের পরিচয় না দিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাথে দেখা করতেও পারিনি। নিয়মিত গণশুনানি তো দূরের কথা।

“স্যাররা সবসময় মিটিং এ থাকেন। কাস্টমস, বন্দর, পুলিশ, বিআরটিএ তে নিয়মিত শুনানি হবে! বাংলাদেশে ভূমিকম্প হয়ে যাবে, এ দপ্তরগুলো বদলাবে না।”

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, “স্বাস্থ্যখাত দুর্নীতিগ্রস্থ খাতগুলোর একটি। মানুষের চাহিদা থেকে আমরা এখনো দূরে আছি।”

সনাক চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, দালালরা অফিসে জায়গা নিয়েছে। তাদের মাধ্যমে সেবাপ্রার্থীদের যেতে হয়।

“পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারীরাসহ ট্রান্সফরমার চুরি করে ট্রাকে করে নিয়ে গেছে, এমন সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। চট্টগ্রামে কিছুদিন আগে ট্রান্সফরমার চুরির হিড়িক পড়েছিল।”

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম মোবারক উল্লাহ বলেন, “দালাল আমি চিনি। কিন্তু এরকম দালালও আছে, যাকে কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় স্থানীয় সাংসদের সাথে সে ওঠাবসা করে।”

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাসুকুর রহমান বলেন, “মনে হয়না সরকারি কর্মকর্তারা এত ‘রিজিড’ যে কেউই অফিসে ঢুকতে পারছেন না।

“কর্মব্যস্ততার কারণে কেউ কেউ হয়তো সময় দিতে পারছেন না। সেবা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।”

সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “যেসব অভিযোগ উঠে এসেছে, কিছুদিন পর আপনাদের রিয়েলিটি ফেস করতে হবে। তখন হয়ত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।”

সভা সঞ্চালনা করেন দুদক চট্টগ্রামের পরিচালক আবু সাঈদ।