রাজস্ব আদায়ে এনবিআরকে আস্থা বাড়ানোর তাগিদ

‘পুলিশ ম্যান থিওরি’র পরিবর্তে পারস্পরিক আস্থা ও সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী ট্যাক্স আদায় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতি পরামর্শ এসেছে চট্টগ্রামের এক আলোচনা সভায়।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2017, 11:13 AM
Updated : 20 August 2017, 11:27 AM

শনিবার নগরীর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে এনবিআর আয়োজিত ‘নতুন আয়কর আইন: জনপ্রত্যাশা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় নতুন আয়কর আইনকে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব করার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়।

এছাড়া নতুন আইনকে সহজ ও করজাল সম্প্রসারণ করা এবং দৈবচয়নের নামে হয়রানি বন্ধ করতে এনবিআরকে তাগিদ দিয়েছেন আলোচনায় অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, আইনজীবীরা।

এনবিআর সদস্য (আয়কর নীতি) পারভেজ ইকবালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সেলিম উদ্দিন বলেন, যে কোনো আইন করার ক্ষেত্রে কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক থাকতে হবে। তবেই যে লক্ষ্য নিয়ে আইনটি করা হচ্ছে সেটি পূরণ করা সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, টপ লাইন ঠিক না করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বটম লাইনে ট্যাক্স নেওয়া উচিত না।

ট্যাক্স আদায় বাড়াতে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের সাথে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক বাড়াতেও এনবিআরকে তাগিদ দেন এই শিক্ষক।

“এনবিআরকে ট্যাক্স আদায় বাড়াতে পুলিশ ম্যান থিওরি প্রয়োগ করা যাবে না। রিলেশনশিপ অ্যান্ড ক্রেডিবিলিটি থিওরিতে এনবিআরকে আগাতে হবে। তাহলে অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে পারবে এনবিআর।”

উচ্চ কর হার থাকলে করদাতাদের ‘ইকোনমিক বিহেভিয়রে’ পরিবর্তন ঘটে জানিয়ে তিনি বলেন, ‌‍‍‍‍“উচ্চ কর হার বজায় থাকলে ইললিগ্যাল কমপ্রোমাইজ (অনৈতিক সমঝোত) বেড়ে যায়।”

নতুন আইনে এনবিআরকে ওয়ার্ল্ড ক্লাস ট্যাক্স সার্ভিস নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান হিসাববিজ্ঞানের এ অধ্যাপক।

আলোচনায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‍“আইনটি বৃটিশ আমলের। ১৯২২ সালের আয়কর আইন ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ছিল। সেটি এখন অধ্যাদেশ থেকে আইনে পরিণত হওয়া সময়ের দাবি।”

রাজস্ব সংগ্রহ যাতে বাড়ে সে জন্য নতুন আইনকে ব্যবসাবান্ধব করার উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‍“আয়কর আইনে যেসব হয়রানি, সেটা দূর করতে হবে নতুন আইনে। মনে রাখতে হবে আমরা কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়।”

তিনি নতুন আইনে দৈবচয়ন ও পুনঃমূল্যায়নের নামে হয়রানি বন্ধ করতে এনবিআরকে অনুরোধ জানান।

মাহবুবুল আলম বলেন, ‍“দেশে তিন কোটি ব্যবসায়ী আছেন, যার মধ্যে ট্যাক্স রিটার্ন দেন মাত্র ১২ লাখ ব্যবসায়ী। উচ্চ কর হার বজায় রাখা মানে যে ব্যবসায়ী একবার আয়কর দিতে গিয়ে নাম লিখিয়েছে, তাকে বার বার ক্ষতিগ্রস্থ করা।”

আয়কর দাতার সংখ্যা বাড়াতে এনবিআরকে পরামর্শ দেন তিনি।

আইন করার আগে যাচাই-বাছাইয়ের পরার্শ দিয়ে মতবিনিময় সভায় আইনজীবী মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, ‍“আপনি একজন ব্যবসায়ী হলে যে নির্বিঘ্ন সেবাটা আশা করতেন, সে সেবাটাই যেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা পান নতুন আইনে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”

না হলে কর ফাঁকি দেওয়া ও বিদেশে টাকা পাচার বেড়ে যাবে বলে সতর্ক করেন এ আইনজীবী।

এনবিআরের লোকজনকে দিয়ে কর জরিপ না করিয়ে বেসরকারি কোনো স্বীকৃত সংস্থাকে দিয়ে করালে সুফল বেশি হবে বলে মত দেন তিনি।

এছাড়া ট্যাক্সেশন রিফান্ড পুনঃপ্রবর্তন করার আহ্বান জানিয়ে কর বিভাগের ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন মমিনুল ইসলাম।

আয়কর আইনের জটিলতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আইনস্টাইনের উক্তি, ‘আমি পৃথিবীর সব অংক বুঝি, আয়করের অংক বুঝি না’র উদাহরণ তুলে ধরেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।

তিনি বলেন, ‍“ব্রিটিশদের করা আইনে উপনিবেশিক শাসক ও জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ছিল। সেটা এখনো রয়ে গেছে।”

সেই অবিশ্বাস দূর করে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে এনবিআরের প্রতি আহ্বান জানান আবুল মোমেন।

এনবিআর সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “আদর্শ কর ব্যবস্থায় ট্যাক্স ডিপেনিং হয় না, কর জাল বিস্তৃত হয়। আমরা সেটা করব।”

কর এবং জিডিপির অনুপাত হতাশাজনক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে আইনে সরকার রাজস্ব আহরণ করে, সেগুলো যুগোপযোগী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। লিগ্যাল রিফর্ম (আইনি সংস্কার) খুব চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। কারণ এতে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ঢেলে সাজাতে হয়।

“ব্যবসা-বাণিজ্য যেভাবে পরিচালিত হয় সেটাকে আইন অনুসরণ করবে, ব্যবসা পদ্ধতি আইনকে অনুসরণ করবে না। নতুন আইনে আমরা কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা শুন্যে নামিয়ে আনব, ব্যবসার খরচও যাতে কমে আসে সে বিষয়টিও বিবেচনায় আছে।”

পর্যায়ক্রমে এক কোটি ব্যবসায়ীকে করজালের আওতায় আনার পরিকল্পনার কথাও সভায় জানান তিনি।

সভায় অন্যদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুর রউফ, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার শংকর রঞ্জন সাহা, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মনিরুজ্জামান ও চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনার সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া, কর অঞ্চল-১ এর কমিশনার মাহবুব হোসেন, অঞ্চল-২ এর কমিশনার প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, অঞ্চল-৩ এর কমিশনার মোতাহার হোসেন, অঞ্চল-৪ এর কমিশনার আহাম্মদ উল্যাহ এবং কর আপীল অঞ্চল এর কমিশনার নাজমুল করিম উপস্থিত ছিলেন।