মাটি চাপা থালা, বাটি, ফাতেমার সংসার

কাদার মধ্যে আটকে আছে একটি স্টিলের থালা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকটি প্লাস্টিকের বাটি, আয়না-চিরুনি।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 July 2017, 04:12 PM
Updated : 21 July 2017, 06:07 PM

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পাহাড় ধসে চাপা পড়েছেন বিবি ফাতেমা, সঙ্গে চাপা পড়েছে তার অনেক কষ্টে সাজানো সংসার।

পোশাককর্মী ফাতেমা ঋণের টাকায় সরু পিলার, বাঁশ আর টিন দিয়ে জঙ্গল সলিমপুরের বিবিরহাটে পাহাড়ের ঢালে ঘর করেছিলেন। মাস খানেক আগে সেই ঘরে পার্টিশন দিতে আরও কিছু ধার করে টিন কিনেছিলেন।

টানা বৃষ্টির মধ্যে শুক্রবার রাত ৩টার দিকে ওই পাহাড়ের খাড়া ঢাল ধসে পড়ে। মাটি সরিয়ে ফাতেমা ও তার দশ বছর বয়সী ছেলে মো. ইউনূস; ফাতেমার ননদ রাবেয়া এবং তার দুই মেয়ে সামিয়া (৭) ও লামিয়ার (২) লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।

ফাতেমার স্বামী রফিকুল ইসলাম, তাদের দুই মেয়ে জান্নাত (১৪) ও সালমা (১১) এবং রফিকের ভাই গিয়াস উদ্দিন প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু তাদের সব কিছুই কেড়ে নিয়েছে পাহাড়।

রফিকের বাড়ি নোয়াখালী জেলার চরজব্বার এলাকায়। বছর দশেক আগে তারা সলিমপুরে থাকতে শুরু করেন। রফিক অটোরিকশা চালান, আর তার স্ত্রী ফাতেমা কাজ করতেন স্থানীয় একটি গার্মেন্টে। 

জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় পাহাড় ধসে ভেঙে পড়া বিবি ফাতেমার ঘর

যে পাহাড়ে তারা ঘর করেছিলেন, স্থানীয়দের কাছে তার নাম বেলতলা পাহাড়। আরও কয়েকটি পরিবারের ঘর রয়েছে সেখানে।

প্রতিবেশী নাসিমা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রায়ই তাদের বাসায় যাওয়া আসা ছিল ফাতেমার। শেষবার তাদের দেখা হয় বৃহস্পতিবার রাতে।

“খুব বৃষ্টি… রাত ৯টার দিকে ফাতেমা আসলো। আমার সাথে বসে পান খেলো। আমাকে আরও একটা পান দিয়ে চলে গেল। ভোরের আগে আগে ভয়ঙ্কর শব্দ, বুঝলাম পাহাড় ভেঙে পড়ছে।”

প্রায় খাড়া ঢালের ওই পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ার পর ফাতেমাদের ঘর ভেঙে নিচে নেমে যায়। রফিকুল ইসলাম ও তার ছোট মেয়ে সালমা ভাগ্যক্রমে বেরিয়ে আসতে পারলেও পরিবারের বাকিরা মাটি চাপা পড়েন।

নাসিমা আক্তার বলেন, সালমা অন্ধকারের মধ্যেই নিচে নেমে এসে তার ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয়। তখন তার ছেলে এমরান ছুটে যায় সালমাদের ঘরের দিকে।  

এমরান জানান, তিনি গিয়ে গিয়াস উদ্দিনকে বেরিয়ে আসতে দেখেন। বাকিরা টিন আর মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। জান্নাতকে টেনে অর্ধেক বের করার পর এলাকার আরও কয়েকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। সবাই মিলে জান্নাতকে বের করতে পারলেও বাকিদের আর বাঁচানো যায়নি। 

এই ঘরের নিচে চাপা পড়ে তিন শিশুসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়

বেলতলা পাহাড়ে দুটি বসত ঘরের মাঝ দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা পথ ধরে পেছনে গেলেই ছোট্ট একটি পাহাড়ি ছড়া।

সেই ছড়ার ওপর দিয়ে পাহাড়ের মাটি কেটে বসানো হয়েছে বালির বস্তা। বস্তার সিঁড়ির ১০ ধাপ পেরিয়ে উঠলে দুই পাশে দুটি ঘর। সেখান থেকে আরও ৩০ ধাপ উঠলে ঢালের ওপর ছিল বিবি ফাতেমার ঘর।

ফাতেমার ঘরের লাগোয়া পাহাড়টি খাড়া হয়ে ধসে পড়েছে। ধসে পড়া অংশের বেশিরভাগ মাটি ফাতেমার ঘর হয়েই নিচে নেমেছে।

তাদের আরেক প্রতিবেশী জোৎস্না জানান, রফিক শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশিরভাগ সময়ই গাড়ি চালাতে পারতেন না। ফলে ফাতেমার চাকরির ওপর তাদের অনেক বেশি নির্ভর করতে হত। বছর দুই আগে ফাতেমাই ধারকর্জ করে বেলতলা পাহাড়ে ওই ঘর তোলেন।

কান্না থামছে না ফাতেমার মেয়ে জান্নাতের

রফিকের বোন রাবেয়া স্বামীর সঙ্গে রাগারাগি করে গত রোজার মাসে দুই সন্তানকে নিয়ে ভাইয়ের বাসায় চলে আসেন। পরিবারের সদস্য বাড়ায় ঘরের ভেতর পার্টিশন দিতে কিছুদিন আগে ফাতেমা আবার ঋণ করে টিন কেনেন বলে জানান জোৎস্না।

মা আর ভাইকে হারিয়ে জান্নাত ১৪ বছর বয়সী জান্নাত হাউমাউ করে কাঁদছিল। আর তার বাবা রফিক সব হারিয়ে মুর্ছা যাচ্ছিলেন বারবার।

১ নম্বর সলিমপুর ওয়ার্ডের সদস্য গোলাম গফুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার বেশি বৃষ্টি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়। মাইকিং করার পর অনেকে সরে গেলেও রফিকের পরিবার থেকে যায়।

রফিকের পরিবারের সদস্যদের লাশ বিকালেই নোয়াখালীর চর জব্বারে তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাদের দাফন হয়েছে বলে জানান গফুর।