উদ্বোধনের আগেই সেতুতে ধস

প্রতি বর্ষায় যে খালের স্রোত ডিঙিয়ে আসা-যাওয়া করতে হত কৃষক আহমদ নবীকে, তার উপর সেতু নির্মাণ দেখে দুর্ভোগ ঘুচে যাওয়ার আশা করেছিলেন তিনি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোমোস্তফা ইউসুফ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 July 2017, 01:36 PM
Updated : 10 July 2017, 02:36 AM

তার সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে; উদ্বোধনের আগেই সেতুটি ধসে পড়ার উপক্রম হওয়ায় তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের ধোপাছড়ি ইউনিয়নের ছাপাছড়ি এলাকার ধোপাছড়ি খালের উপর সেতুটি নির্মাণ শেষ হওয়ার তিন সপ্তাহের মাথায় দেখা দেয় ফাটল।

ফলে স্থানীয় সংসদ সদস্যের গত ১৫ জুন সেতুটি উদ্বোধনের কথা থাকলেও তা আর হয়নি।

এটি ধসে যাওয়ার পেছনে ঠিকাদাররা দুষছেন গত ১৩ জুনের ভারি বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলকে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণ করা হয়।

এটি এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হওয়ায় আক্ষেপের অন্ত নেই কৃষক আহমদ নবীর মতো এ এলাকার বাসিন্দাদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুটির নামফলকে লেখা ‘প্রধামন্ত্রীর বিশেষ উপহার’। স্থানীয় সংসদ সদস্যের নামে উদ্বোধন করার কথাও উল্লেখ আছে নামফলকে।

মাঝখানে দেবে যাওয়া সেতুর গায়ে এখন বড় বড় ফাটল। দুদিকের সংযোগ সড়কের জন্য ভরাট করা মাটি সরে গেছে। সেখানে কাঠের পাটাতন দিয়ে আপাতত মানুষ চলাচল করছে।

আট মাইল দীর্ঘ ‘কুমারী সড়কের’ ছাপাছড়ি এলাকায় পড়ে ধোপাছড়ি খাল। খালের উপর কাঠের পাটাতন দিয়ে স্থানীয়রা সড়কের অন্য পাশে যাতায়াত করতেন এতদিন।

আহমদ নবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বছরের অন্যান্য সময় কাঠের সেতু বানিয়ে নিই আমরা। কিন্তু বর্ষা এলে পাহাড়ি ঢলে সে সেতু ভেঙে যায়। তখন বুক সমান পানির স্রোত ভেঙে আমাদের আসা যাওয়া করতে হয়।

“পাকা সেতু হতে দেখে ভেবেছিলাম কষ্টের দিন শেষ হতে চলেছে। কিন্তু সে সেতুও কাঠের সেতুর মতো ভেঙে গেছে। আমাদের দুঃখ শেষ হবে না।”

ধোপাছড়ি ইউনিয়নের উত্তর অংশের প্রায় ১০ হাজার মানুষের বাস। খালের উপর এ সেতুটি হলে তাদের ব্যবহার ও চলাচল সহজ হত। ফলে আক্ষেপ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল জব্বারের।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখানকার অধিকাংশ মানুষই কৃষিনির্ভর। তাদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে বর্ষাকালে এ খাল পার হতে খুব দুর্ভোগে পড়তে হয়।

“আমাদের দুর্ভাগ্য পাকা সেতুটিও ধসে গিয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।”

নির্মাণ কাজে যুক্ত স্থানীয় এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খালে সচরাচর দেড় থেকে দুই ফুট পানির নিচে বালির স্তর। বালির স্তর থেকে মাত্র তিন ফুট নিচে ব্রিজের পাইলিং হয়েছে।

গত ১৩ জুনের ভারি বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে পাইলিংয়ের ১৫ ফুট নিচ থেকে মাটি সরে গেলে সেতুটি ধসে পড়ে বলে জানান ওই শ্রমিক।

জানতে চাইলে সেতুটির নির্মাণকারী ঠিকাদারি সংস্থা ‘এ কে সিন্ডিকেট কনস্ট্রাকশন কোম্পানী’র মালিক মো. আরিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খালে ১০০ ফুট জায়গা দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও সেতুটি হয়েছে মাত্র ৬০ ফুট।

“আমাদের যেভাবে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছে সেভাবেই আমরা কাজটি করেছি। খালের বালির স্তর থেকে কমপক্ষে ৮৫ ফুট গভীর পাইলিং করতে হবে। এখানে করতে হবে মিনিমাম আড়াই কোটি টাকার একটি ব্রিজ।”

নির্মাণে কোনো দুর্নীতি হয়নি দাবি করে আরিফ বলেন, “আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। বরাদ্দের সব অর্থ ব্যয় করেই ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছে।”

সেতুটির নির্মাণ শেষ হওয়ার সময়সীমা ছিল তিন মাস; ৪১ দিনের মধ্যেই তার কাজ শেষ করেন ঠিকাদার।

আরিফ বলেন, “যখন ঢালাই হচ্ছিল তখন স্থানীয় চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রশাসনের লোক সবাই উপস্থিত ছিলেন। স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করেছি।”

পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা গাছের বড় বড় গুঁড়ির আঘাতকে সেতু ধসের কারণ হিসেবে দেখান ঠিকাদার আরিফ।

টিকাদারের এই বক্তব্য সমর্থন করছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়েরর অধীন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এত পাহাড়ি স্রোত সচরাচর হয় না ধোপাছড়ি খালে।

“পাহাড়ি ঢলের সাথে গাছের বড় বড় গুঁড়ি এসে ব্রিজের এভার্টমেন্ট ওয়ালে (যেটার উপর ব্রিজের ঢালাই দেয়া হয়) লেগে ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়ে পাইলিংয়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। ফলে ব্রিজটি দেবে গেছে।”

নির্মাণ কাজে কোনো ত্রুটি হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

তবে ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটা কমিটি গঠন করেছেন চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লুৎফুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চার সদস্যের তদন্ত কমিটিকে ১০ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে। ১৫ ‍জুলাইয়ের মধ্যে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পাব।”

তদন্তে কোনো দুর্নীতি কিংবা কারও বিরুদ্ধে গাফিলতির কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হবে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।