ওদের আর কেউ রইল না

মা, স্ত্রী আর তিন সন্তানকে নিয়ে সাজানো সংসারে অভাব-অনটন থাকলেও অন্তত মুখে হাসিটা ছিল একদিন আগেও। প্রকৃতির নির্মমতা দিনমজুর মফিজুরের সেই মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে।

উত্তম সেনগুপ্ত, রাঙ্গুনিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2017, 10:55 AM
Updated : 14 June 2017, 10:55 AM

ভারি বৃষ্টিতে মঙ্গলবার রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়নের মঘাইছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসে সবাইকে হারিয়েছেন মফিজুর। সঙ্গে নতুন কেনা ঘরের আসবাবপত্রও গেছে মাটির গর্ভে। নিজের পরনে শার্ট আর লুঙ্গি ছাড়া মফিজুর এখন নিঃস্ব।  

টানা বর্ষণে রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে পাহাড় ধসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে শতাধিকে দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রামে গাছ চাপা, দেয়াল চাপা ও পানিতে ভেসে আরও কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়নের মইন্যারটেক ও পাহাড়তলী ঘোনা, রাজানগর ইউনিয়নের জঙ্গল বগাবিল, চন্দনাইশ উপজেলার ধোপাছড়ি ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের শামুকছড়ি ও ছনবনিয়া এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।

মাটি চাপা পড়া ঘরের সামনে দ্বীন মোহাম্মদ

বুধবার সকালে কথা হয় রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়নের মঘাইছড়ি এলাকার মফিজুরের সঙ্গে।

তিনি জানান, মঙ্গলবার সকালে বৃষ্টি মাথায় করেই কাজের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। পাহাড় ধসের খবর পেয়ে ফিরে এসে আর কাউকে জীবিত পাননি।

পাহাড়ের মাটি চাপায় মারা গেছে মফিজুরের তিন সন্তান মুনমুন (৭), সাজ্জাদ হোসেন হিরু (৯) ও মানিকুর রহমান (১১), স্ত্রী জোৎস্না বেগম (৪০) এবং মা রিজিয়া বেগম (৭০)।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মফিজুর বলেন, “মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে সবাই বাড়িতে ছিল। খুব বৃষ্টি পড়ছিল।

“সকালে কাজের খোঁজে বের হয়ে বাজারের একটি দোকানে গিয়ে বসি। তখন পাশের বাড়ি থেকে খালাত বোনের ফোন পেয়ে ছুটে আসি। এসে দেখি ঘরের ওপর মাটি চাপা। মুনমুনকে এলাকার লোকজন মিলে দেড় ঘণ্টা পর মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করে। এরপর স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি জানান মুনমুন মারা গেছে।”

হতবিহ্বল মফিজুর বলেন, “অনেক কষ্টে ঘরে কিছু জিনিসপত্র কিনেছিলাম। পরিবারের সবাইকে হারালাম। জিনিসপত্রও সব গেছে। এখন আমার কিছুই নেই।”

রাঙ্গুনিয়ার মঘাইছড়িতে পাহাড় ধসের চিহ্ন

মফিজুরের বাড়ির বিপরীতে ইটভাটার শ্রমিক দ্বীন মোহাম্মদের বাড়ি (৫০)। পেছনের পাহাড় থেকে ধসে নেমে আসা মাটি চাপায় দুই নাতি নাতি পারভেজ (৭) ও হেসেন আহমেদের (১৭) সঙ্গে স্ত্রীকেও হারিয়েছেন তিনি।

আর ঘরের সামনে বসে থাকায় অবস্থায় মাটির নীচে চাপা পড়ে আহত হন দ্বীন মোহাম্মদের ছেলে ইউসুফ (১৯)।

হাত ও বুকে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে ইউসুফ বলেন, “কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটি এসে গায়ের উপর পড়ে।”

সকাল নয়টার দিকে এ ঘটনার পর স্থানীয়রা ছুটে আসেন। তারাই ১১টার দিকে উদ্ধার করে ইউসুফকে।

উদ্ধারকারীদের একজন মো. ইলিয়াস বলেন, “সকালে পাহাড় ধসে পড়ার ঘটনা দেখতে পেয়ে ছুটে আসি। পানির পাম্প বসিয়ে মাটি সরানো হয়। এরপর দুপুরে স্থানীয়দের উদ্যোগে এক্সক্যাভেটর এনে মাটি কেটে বের করা হয় নিহতদের। 

মঘাইছড়ি এলাকায় নিহতদের মঙ্গলবার রাতেই দাফন করা হয়েছে। 

তিন মাস আগে আবুধাবী থেকে ফিরেছিলেন উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের বগারবিল পাউক্যাঘোনা এলাকার নজরুল ইসলাম (৪০)। তখনও কি জানতেন স্ত্রী সন্তানের কাছে ফিরে এসেছেন চিরদিনের মতো।

পাহাড় ধসে স্ত্রী আসমা আক্তার আর দুই সন্তান মনজুর ইসলাম (১৫) ও সাথীর (৭) সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন নজরুল। তবে একই গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে থাকায় বেঁচে যান নজরুলের আরেক মেয়ে লাকী আকতার।

লাকী বলেন, “রাতে সবাই খেয়ে ঘুমিয়েছিল। সকালে এসে দেখি সব শেষ।”

এদিকে রাঙামাটি যাওয়ার পথে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া রাঙ্গুনিয়ার রানিরহাট এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সেখানে তিনি নিহত হতাহতদের পরিবারের মধ্যে ত্রাণের টাকা ও চাল বিতরণ করেন।