উদ্বেগের রাত শেষে আতঙ্কের ভোর

বিকাল থেকে তাদের রাত কেটেছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়; ভোরের আলো ফুটতেই বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে সেই উদ্বেগ পরিণত হয় আতঙ্কে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীও মোস্তফা ইউসুফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2017, 04:47 PM
Updated : 16 March 2017, 04:53 PM

সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার ৫ নম্বর প্রেমতলা ওয়ার্ডের ‘ছায়ানীড়’ নামের দ্বিতল বাড়ির বাসিন্দাদের বৃহস্পতিবার সকালে যখন বের করে আনা হয়, তাদের চোখে তখন হতবিহ্বল দৃষ্টি।  

কেবল ওই বাড়ির বাসিন্দারা নন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘ জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পুরোটা সময় স্থানীয় সবারই আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে। বৃহস্পতিবার বিকালেও তাদের কথায় সেই উদ্বেগের রেশ পাওয়া যায়।  

ছায়ানীড়ের দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা হাসিনা বেগম (৬৫) ও তার পরিবারের সদস্যদের সকালে বের করে আনেন সোয়াট সদস্যরা ।

হাসপাতালে পাঠানোর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই বৃদ্ধা বলেন, “সারা রাত গোলাগুলি। ভাবতে পারিনি বেঁচে ফিরতে পারব। সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ শুকরিয়া, শেষ পর্যন্ত সবাই নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।”

বুধবার বিকালে ওই বাড়িতে অভিযানের শুরুতেই ভেতর থেকে জঙ্গিদের ছুড়ে দেওয়া বোমায় আহত হন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এরপর সারারাত ওই জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রেখে ভেতরে ঢোকার প্রস্তুতি চলে। বোমা বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ পাওয়া যেতে থাকে কিছুক্ষণ পরপর।

পুলিশ বলছে, ছায়ানীড়ের দুটি তলার আটটি ইউনিটের মধ্যে নিচতলায় সিঁড়ির পাশের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সেখানে আস্তানা বানিয়েছিল নব্য জেএমবির জঙ্গিরা। কিন্তু আকস্মিক ঘেরাওয়ের পর অন্য সাতটি ইউনিটের বাসিন্দারাও বাড়ির ভেতরে আটকা পড়েন।

পুলিশ কর্মকর্তারা রাতেই ওই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা বেরিয়ে আসতে চাইলেও পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নিষেধ করা হয়। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে অনিশ্চয়তা নিয়ে রাত কাটে তাদের।       

সকাল সাড়ে ৬টার দিকে শুরু হয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও সোয়াটের ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’। তারা ওই বাড়ির ছাদে উঠলে সুইসাইড ভেস্টে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হন দুই জঙ্গি। পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে ওই বিস্ফোরণে। 

আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারী ও এক শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ১৯ ঘণ্টার এ অভিযান।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি সফিকুল ইসলাম বলেন, “সাধারণ নাগরিকদের বের করে আনার জন্য গত রাতে আমরা কয়েকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আজ সকালে জঙ্গিরা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর পর আবার চেষ্টা শুরু করি।”

সকালের অভিযান শুরুর দুই ঘণ্টার মধ্যে একে একে কয়েকটি পরিবারের ২০ সদস্যক বের করে আনা হয়। বিকালে উদ্ধার করা হয় ৯০ বছর বয়েসী এক বৃদ্ধকে।

বাড়ির প্রবেশ পথে ও সিঁড়িঘরে জঙ্গিরা শক্তিশালী বিস্ফোরক ফেলে রাখায় জানালার গ্রিল কেটে বাড়ির বাসিন্দাদের একে একে বের করে আনেন সোয়াট সদস্যরা। পরে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের সদস্যরা বাড়ির ভেতর থেকে বোমা সরিয়ে নেন।

বাঁশবাড়িয়ার ইউপি সদস্য মো. সেলিমের পরিবার ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। সকালে উদ্ধার পাওয়ার পর তার স্ত্রী ইয়াসমিন বলেন, “আমরা গতকাল বের হতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ ভেতরেই থাকতে বলল। সারা রাত উপরতলায় হাঁটা-চলার শব্দ পেয়েছি, আর আল্লাহু আকবার বলে চিৎকারের পর বোমার আওয়াজ। কি যে আতঙ্কে কেটেছে…।”

তবে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে থাকায় জঙ্গিদের কাউকে দেখেননি বলে জানান ইয়াসমিন।

ওই এলাকার মুদি দোকনী শহীদুল ইসলাম থাকেন ছায়ানীড় ভবনের পাশেই আরেক বাড়িতে। বুধবার বিকালে কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছিলেন। রাতে বাসার কেউ আতঙ্কে ঘুমাতে পারেননি। ভোরে বিকট বিস্ফোরণে সব কেঁপে উঠলে সেই আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়।

“তখনও বাসা থেকে বের হওয়ার সাহস হয়নি। সব শান্ত হওয়ার পর আমাদের বাসার ছাদে উঠে দেখি একটা হাত পড়ে আছে। পেছনের জমিতে চুল, উঠানে বিভিন্ন জায়গায় হাড়ের টুকরাও দেখেছি।”

ছায়ানীড়ের ঠিক পেছনের টিনশেড বাসায় স্ত্রী আর তিন সন্তানকে নিয়ে থাকেন মাহবুব আলম। তারাও সবাই মিলে একটি ঘরে উদ্বেগ নিয়ে রাত পার করেছেন।

স্থানীয় কাউন্সিলর শফিউল আলম চৌধুরী মুরাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু ওখানে নিরীহ লোকজন আটকা পড়েছিল, আমাদের সবারই উদ্বেগ হচ্ছিল- আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সবাইকে নিরাপদে বের করে আনা গেছে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই।”

অভিযান শেষ করার পর চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিজেদের নিরাপদে রেখে, জঙ্গিদের নির্মূল করে বাড়ির সাধারণ বাসিন্দাদের নিরাপদে বের করে আনা ছিল কঠিন কাজ।

“এটি একটি দুঃসাহসিক অভিযান ছিল। আমরা শেষ পর্যন্ত সে কাজটি করতে পেরেছি।”

তিনি বলেন, ওই এলাকায় জঙ্গিদের আরও ‘হাইড-আউট’ আছে কি না, সে দিকে পুলিশ সতর্ক নজর রেখেছে।