কোথাও ‘গড়বড় হয়েছে’ বুঝতে পেরে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিতরণ কেন্দ্রে ছুটে যান বিস্তার আর্ট কমপ্লেক্সের সত্ত্বাধিকারী। সেখানে দেখেন, তিনি একা নন; ‘ভুতুড়ে বিল’ নিয়ে অভিযোগ জানাতে এসেছেন আরও অনেকে।
“আমার আর্ট কমপ্লেক্সে সর্বোচ্চ ছয়টি এনার্জি বাল্ব, তিনটি বৈদ্যুতিক পাখা আর একটি কম্পিউটার চলে। এ জন্য ২২ হাজার টাকা বিল কীভাবে হয় বুঝতে পারছি না। অভিযোগ দিয়েছি, দেখি কি হয়,” বলেন খোরশেদ।
একই সমস্যা পাঠানটুলির রফিকুল ইসলামেরও। তিনি জানান, তার বাসায় এমনিতে বিল হয় ছয় থেকে সাতশ টাকার মধ্যে।
“ডিসেম্বরের বিলে লেখা এক হাজার ২৮১ টাকা। অথচ শীত বলে এ মাসে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে সবচে কম।”
খোরশেদ ও রফিকের মত ‘অতিরিক্ত’ বিলের সমস্যা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রামের ২১টি বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রে ধরনা দিচ্ছেন হাজারও গ্রাহক। তাদের অভিযোগ, ঠিকমত মিটার না দেখেই বিল ধরিয়ে দিচ্ছে পিডিবি।
গ্রাহকদের এ সমস্যার কথা স্বীকার করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (পিডিবি)। তাদের ভাষ্য, বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের বিপরীতে রিডার স্বল্পতায় সবার মিটার সঠিকভাবে দেখা সম্ভব হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি দাশ বলেন, রিডার স্বল্পতায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘ওভার বিলিং’ বা ‘আন্ডার বিলিং’ (ব্যবহৃত ইউনিটের বিপরীতে কম বিল) এর অভিযোগ তারা পাচ্ছেন।
“সর্বশেষ মিটার রিডার নিয়োগ হয়েছে ১৯৯৫ সালে। প্রতি বছর দশ শতাংশ হারে গ্রাহক সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি রিডারের সংখ্যা।”
পিডিবি চট্টগ্রাম জোনের আওতায় থাকা পাঁচ জেলায় প্রায় সাড়ে আট লাখ গ্রাহকের জন্য মাত্র ৬০ জন মিটার রিডার আছেন বলে জানান তিনি।
পিডিবির জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কেবল চট্টগ্রামেই গ্রাহক আছেন পাঁচ লাখ, তাদের বিপরীতে রিডার আছেন ৫০ জন।
এই হিসেবে, সব মিটার ঠিকমত দেখতে প্রতি মাসে একজন রিডারকে পরীক্ষা করতে হবে ১৪ হাজার মিটার, প্রতিদিন দেখতে হবে গড়ে প্রায় ৫শ মিটার।
একে ‘অসম্ভব’ হিসেবে বর্ণনা করে পিডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, একজন রিডারের পক্ষে মাসে বারশর বেশি মিটার দেখা কঠিন।
জনবল সংকটের কারণে এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি দাশ বলেন, সঙ্কট মেটাতে অস্থায়ীভাবে কিছু রিডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গ্রাহক ভোগান্তি কমাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেব প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানান মৃণাল। এরই মধ্যে নগরীর আগ্রাবাদ, খুলশীসহ কয়েকটি এলাকায় ১৯ হাজার প্রি-পেইড মিটার দেওয়া হয়েছে।
“তিন ধাপে এক লাখ ৩৯ হাজার মিটার বসানো হবে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ অপচয় কমে যাবে। সঙ্গে কমবে বিল সংক্রন্ত ঝামেলা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের ঝক্কি থেকেও মুক্তি মিলবে,” বলেন তিনি।
মার্চে দুদকের গণশুনানি
কেবল অতিরিক্ত বিল নয়, বিলের কপিতে নানান ধরনের অসঙ্গতি থাকে বলেও অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা।
পাঠানটুলির রফিকুল ইসলাম জানান, তার বিলে ইস্যুর তারিখ লেখা আছে ২৫ জানুয়ারি; আর বিল পরিশোধের তারিখ দেওয়া ২৬ জানুয়ারি।
“একদিন আগে ইস্যু করে পরদিনই বিল জমা দেওয়ার শেষ তারিখ কীভাবে হয়? তারিখ পার হয়ে গেলে আবার জরিমানা দিতে হবে,” বলেন ক্ষুব্ধ এ গ্রাহক।
জামাল খানের বাসিন্দা দেবু মহাজনের অভিযোগ, তিনি বকেয়ার টাকা পরিশোধ করলেও পরের মাসে আবার বকেয়াসহ বিল দেওয়া হয়েছে তাকে।
গ্রাহকদের এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ গত ১৮ জানুয়ারি পিডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দিন আহমদ।
ওই বৈঠকে তিনি বলেন, অতিরিক্ত বিল, নির্দিষ্ট সময়ে না পৌঁছানো, সীমা বহির্ভূত ‘সিস্টেম লস’, শিল্প-কারখানার লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিল ‘ঘুষ দিয়ে কমানো’সহ অসংখ্য অভিযোগ দুদকের হাতে আছে।
এসব অভিযোগ ও বিদ্যুৎসেবার প্রকৃত চিত্র জানতে মার্চের শেষে পিডিবি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গণশুনানিরও আয়োজন করছে দুদক।
সেখানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দোষীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও নাসিরউদ্দিন জানিয়েছেন।