অনিরাপদ নির্মাণকাজে মরছে মানুষ, উদাসীন সিডিএ

পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া ব্যস্ত সড়কসংলগ্ন নির্মাণাধীন ভবন বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পথচারীদের জন্য মৃত্যফাঁদে পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোমোস্তফা ইউসুফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Jan 2017, 11:47 AM
Updated : 10 Jan 2017, 12:23 PM

পাশ দিয়ে হাঁটার সময় বহুতল এসব স্থাপনা থেকে লোহার রড, ইট ও বাঁশসহ নানা নির্মাণসামগ্রী মানুষের গায়ের উপর পড়ে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় পথচারীদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও তা মানছেন না নির্মাণাধীন ভবনগুলোর মালিকরা। এবিষয়ে তদারকি সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরও (সিডিএ) নজরদারি নেই।

২০১৪ সালের মে থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে এ ধরনের ঘটনায় এক শিশুসহ চার জনের মৃত্যু হয়েছে। খোদ সিডিএর একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে লোহার রড পড়ে আহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।

নতুন বছরের প্রথম দিন ইপিজেড থানার আবদুল মাবুদ সওদাগর লেইন এলাকায় মো. মহিউদ্দিনের নির্মাণাধীন ছয় তলা ভবন থেকে মাথায় বাঁশ পড়ে গুরুতর আহত হন চট্টগ্রাম বিএএফ শাহীন কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আবিদুর রহমান রাকিব। সাত দিন চিকিৎসাধীন থেকে শনিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

রাকিব আহত হওয়ার কয়েকদিন আগে ওই ভবন থেকে হাতুড়ি পড়ে এক রিকশাচালক আহত হন বলে জানান রাকিবের মামা আবুল হাশেম আঙ্গুর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তখন ভবন মালিককে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানাই। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এর দুই দিন পর মাথায় বাঁশ পড়ে রাকিব আহত হয়।”

নির্মাণাধীন ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সিডিএর কেনো পদক্ষেপ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে হাশেম বলেন, “যদি সংশ্লিষ্ট সংস্থা এসব নিয়মিত তদারক করত, আর ভবনের নিরাপত্তা বেষ্টনির ব্যবস্থা থাকত তাহলে রাকিবকে অকালে প্রাণ হারাতে হতো না।”

এবিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি ওই ভবনের মালিক মো. মহিউদ্দিন।

ইট পড়ে শিশু নিহত, রড পড়ে নারী আহত

গত তিন বছরে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট-রড-লোহার পাত পড়ে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

গত বছরের অগাস্টে জামালখান এলাকায় নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন থেকে লোহার রড পড়ে আহত হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. সঞ্জয় দাশ।

১৯ মে বাকলিয়ায় ফুলকলি বেকারির পাশে নির্মাণাধীন ভবন থেকে মাথায় ইট পড়ে মো. হোসেন আহমদ নামের ১২ বছর বয়সী এক শিশু মারা যায়।

ঠিক একমাস আগে নগরীর কাপাসগোলা এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট ও নির্মাণসামগ্রী পড়ে নুরনবী (৩০) নামের এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়, আহত হয় আরও এক শ্রমিক।

২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে নগরীর কাজীর দেউড়ি কাঁচা বাজারসংলগ্ন সিডিএর নির্মাণাধীন নিজস্ব ভবন থেকে লোহার রড ছিটকে পড়ে বাজারের ছাউনি ভেদ করে এক নারীর বাম হাতে গেঁথে যায়।

২০১৪ সালের ৯ মে নগরীর বন্দর থানার সিমেন্স হোস্টেল এলাকার বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটার সময় স্থানীয় জয়নাল আবেদীনের নির্মাণাধীন পাঁচ তলা ভবনের ছাদ থেকে লোহার পাত ছিটকে মাথায় পড়লে স্থানীয় যুবক মো. রাশেদ (২২) মারা যান।

তবে অনিরাপদ এসব নির্মাণকাজের কারণে সংঘটিত এসব হতাহতের কোনো ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ না আসায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি বলে দাবি করেন সিডিএর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান।

নগরীর জামালখান, কাজীর দেউড়ি, বন্দর, ইপিজেড, বায়েজিদ, বাকলিয়া ও হালিশহরসহ বেশ কিছু এলাকায় গত কয়েকদিন সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ নির্মাণাধানী ভবনেরই কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনি নেই, ঝুঁকি নিয়ে এসব ভবনের নিচ দিয়ে চলাচল করছে মানুষ।

এবিষয়ে শাহীনুল বলেন, “নির্মাণাধীন ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে টিন দিয়ে প্রোটেকশন রাখার নিয়ম, যাতে নিচে কোনো নির্মাণসামগ্রী পড়তে না পারে।”

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা (২০০৮) অনুযায়ী, নির্মাণাধীণ ভবন থেকে নির্মাণসামগ্রী পড়ে কেউ নিহত হলে ভবন মালিকের সাত বছরের জেলের বিধান রয়েছে।

সিডিএর পক্ষ থেকে নিয়মিত নির্মাণাধীন ভবন তদারকের দাবি করলেও পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্বাহী ম্যাজিট্রেটের নেতৃত্বে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো ‘ভিজিল্যান্স টিম’ নেই বলে জানান সিডিএর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ।

শাহিনুল বলেন, “ভবন নির্মাণ বিধিমালা নিয়ে আমরা পত্রিকায় খুব শিগগির প্রচারণায় যাব, যাতে ভবন মালিকেরা আইন মানেন আর সাধারণ মানুষ যাতে সচেতন হয়।”

ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা আছে, ফুটপাত সংলগ্ন কোনো ভবন নির্মাণের সময় ভবন মালিককে ওই স্থানে অস্থায়ী ঘের, জীবনরক্ষাকারী বাধা (শিল্ড) এবং বিকল্প চলাচলের পথ তৈরি করে পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ভবন নির্মাণ চলাকালে নির্মাণসামগ্রী রাস্তায় রেখে জনসাধারণের চলাচলে কোন বাধা তৈরি না করার কথাও আছে বিধিমালায়।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় এ ধরনের ঘটনায় দোষীদের শাস্তির বিধান থাকলেও এ ধরনের শাস্তি প্রদানের কোনো নজির নেই।

এবিষয়ে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সদস্য নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন, আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় দোষী ভবন মালিকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তারা মানুষের জীবনের মূল্যই দিচ্ছে না।

“বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়ে ১৩ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করে এবিষয়ে সিডিএ কতটা উদাসীন।”