শিল্পীর ‘স্যাটায়ার’, দর্শকের ‘সেলফ সেন্সর’

চট্টগ্রাম নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে কল্পনা চাকমার আপাদমস্তক ছবি, যার ভেক্টরের লেখায় সেলফি তোলার আহ্বান। কিন্তু আশেপাশে তেমন ভিড় নেই। আগ্রহীরা কল্পনা চাকমার ছবি দেখছেন, কী লেখা আছে তা পড়েও দেখছেন। তবে আহ্বান অনুসরণ করে সেলফি তুলছেন না কেউই।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2016, 04:52 PM
Updated : 9 Dec 2016, 05:45 PM

‘সেলফি উইথ কিডন্যাপড বডি’ লেখা ওই শিল্পকর্মের ভেক্টরে লেখা আছে, ‘প্রিয় বাঙালিরা, আমি কল্পনা চাকমা। আমার সাথে সেলফি তুলুন এবং আপলোড করুন।’

এই শিল্পকর্মের শিল্পী রাজীব দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চেয়েছিলাম মানুষ সেলফি তুলবে এবং এই শিল্পকর্মের সাথে মানুষের এক ধরনের মিথস্ক্রিয়া হবে।

“তবে দর্শনার্থীদের মধ্যে সেলফি তোলায় তেমন আগ্রহ নেই। এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ কাজ করছে। মূলত এই শিল্পকর্মের মধ্যে একটা স্যাটায়ার আছে।”

এরকম নানা ব্যতিক্রমী শিল্পকর্ম নিয়ে নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে দুই দিনব্যাপী ‘চেরাগী আর্ট শো ৫’ আয়োজন করেছে যোগ আর্ট স্পেস নামের একটি সংগঠন। এটি তাদের পঞ্চম আয়োজন।

প্রতিদিনের চেনা মুচি, চটপটি ওয়ালা, ভ্রাম্যমাণ ঝালমুড়ি বিক্রেতা, খাবারের দোকান, চা দোকানের সামিয়ানা টাঙ্গানো বাঁশ- এসবের ফাঁকে ফাঁকেই চলেছে পাবলিক আর্টের প্রদর্শনী।

কোথাও টিনের রঙ্গিন দেয়ালে চলছে ভিজুয়াল আর্টে। বন্ধ দোকানের শার্টারে টাঙানো হয়েছে ছবি; আর খবরের কাগজ টাঙানোর বোর্ড হয়ে উঠেছে শিল্পীর ক্যানভাস।

খাবারের দোকানের সামনে টুলের ওপর অর্ধেক মুখ রুপোলি রংয়ে রাঙ্গিয়ে বসে আছেন এক শিল্পী। তার চারপাশে টাঙানো কাগজে ছাপা পাঁচশ-হাজার টাকার নোট।

চেরাগী পাহাড়ের নিত্যদিনের ছিন্নমূল শিশুরা সেসব টাকা খুলে নিচ্ছে। আর যেই দেখতে পাচ্ছে তা কাগজের তখনই ছুড়ে ফেলছে।

ছিন্নমূল শিশুদের কেউ কেউ সেসব কাগজে ছাপা নোট দেখিয়ে দর্শনার্থীদের কাছেই জানতে চাইছে, ‘এইগুলা কি?’।

আয়োজক সংগঠক যোগ আর্ট স্পেস’র সদস্য শিল্পী জিহান করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার স্ট্রিট আর্ট শোর মূল স্লোগান ‘বডি অ্যান্ড মাইন্ড’। ঢাকা-চট্টগ্রামের মোট ২৮ জন শিল্পী অংশ নিচ্ছেন।

“শুধু চিত্রশিল্পী নন, এবার যোগ দিয়েছেন প্রকৌশলী, আলোকচিত্রী আর ভিজ্যুয়াল আর্টের শিল্পীরাও।”

শুক্রবার পড়ন্ত বিকালে চেরাগী পাহাড় মোড়ে আসতেই দৈনিক আজাদী টানানোর জন্য বসানো বোর্ডের লোহার খোপে দেখা মেলে বেশ কিছু খাম খোলা চিঠির।

অটোরিকশার চালক, পথচলতি মানুষ, মুচির কাছে জুতো সারাতে আসা লোকজন সেই সব চিঠি নিয়ে পড়বে কি না তা নিয়ে একটু ভাবে।

তারপর একজন-দুজন সেসব চিঠি থেকে কোনোটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করে।

এসব চিঠিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা লিখে রেখেছে তাদের নানা কষ্টের কথা। চিঠি পড়ে ফেরার সময় পাঠকের চেহারায় মন খারাপের ছায়া।

পাশেই লোহার খোপে ঝুলতে থাকে মাটির বানানো পুতুল, হাড়ি-পাতিল, খেলনা।

‘একপ্লোডিং দ্যা হিডেন বডি’ শিরোনামের এই শিল্পকর্মের শিল্পী সোমা সুরভি জান্নাত ঢাকার বাসিন্দা।

শান্তি নিকেতন ফেরত জান্নাত বলেন, ট্রান্সজেণ্ডারদের সাথে সাধারণের ‍দূরত্ব ঘোচাতে এই প্রয়াস। মাটির খেলনাগুলো বানিয়েছে ট্রান্সজেণ্ডার আর চেরাগীতে যারা নিয়মিত আসেন তারা মিলে।

এছাড়া নজর কেড়েছে টিনের বেড়ার ওপর প্রজেক্টর থেকে ফেলা আলো-ছায়ার খেলায় দিলারা বেগম জলির ভিজ্যুয়াল আর্ট ‘আই’।

জোড়া জোড়া চোখ তাকিয়ে থাকে নারীদের দিকে। এসব চোখ আসলে কী খোঁজে। নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন শিল্পী।

‘ভক্তি আর ভালোবাসার’ কথা বলতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মাইজভাণ্ডার শরিফের আদলে তৈরি করা হয়েছে ‘মাইজভাণ্ডার’ নামের শিল্পকর্ম।

সেখানে শিল্পী সাখাওয়াত হোসেন মাইজভাণ্ডার নিয়ে তার মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন আলোকচিত্রে। দর্শকদের মাঝে তুলে ধরেছেন সেসব ছবি।

এতসব আয়োজনের মাঝে হঠাৎ পেছনের গলি থেকে পটকার শব্দ, আতশবাজি আর ব্যান্ড পার্টির বাজনা। সানাই-ঢোলের বাজনার সঙ্গে সারিবদ্ধ বরযাত্রী আর বরের গাড়ি বের হয় ধীর লয়ে।

আর্ট শোর মাঝামাঝি সড়ক ধরে এগিয়ে যায়। কোনো কোনো দর্শনার্থী সত্যিকারের এই বরযাত্রাকেও ভেবে নেয় আর্ট শোর এক পারফরম্যান্স হিসেবে।