সেইসঙ্গে ট্যাংক বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তার গাফিলতিকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানার উপ প্রধান প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) দিলীপ কুমার বড়ুয়া এবং মহা ব্যবস্থাপক (ব্যবস্থাপনা) নকিবুল ইসলাম তাদের দায়িত্ব ‘সঠিকভাবে পালন করেননি’।
তদন্ত কমিটি ওই দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে বিভাগীয় শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের আনুতোষিক থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশ করেছে বলে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন জানিয়েছেন।
দুর্ঘটনায় গ্যাস ছড়িয়ে অর্ধশতাধিক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ার নয় দিনের মাথায় বুধবার এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে মেজবাহ উদ্দিন সাংবাদিকদের সামনে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোমিনুর রশিদও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
৫০০ টন ধারণক্ষমতার ওই ট্যাংকে ৩৪০ টন তরল অ্যামোনিয়া ছিল জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যামোনিয়া ট্যাংকটির নিরাপত্তার জন্য পাঁচ ধরনের সুরক্ষা যন্ত্র ছিল; যার সবগুলোই ছিল অকেজো।
এর মধ্যে ট্যাংকের তাপমাত্রা কমানোর কুলিং কম্প্রেসার সিস্টেম তিন বছর ধরে অকেজো। গ্যাসের চাপ মাপার দুটি প্রেশার গজ বিকল ছিল বহুদিন। ট্যাংকের তাপ ও চাপ মাপার স্বয়ংক্রিয় ডিসিএস সিস্টেমের দুটি কম্পিউটারের মধ্যে একটি আগে থেকেই এবং অপরটি দুর্ঘটনার আগেরদিন নষ্ট হয়।
এছাড়া ট্যাংকে চাপ বেড়ে গেলে অতিরিক্ত গ্যাস বের করে দেওয়ার জন্য দুটি প্রেশার ভল্ট এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্লেয়ার সিস্টেম ছিল। সেগুলোও অকেজো ছিল বলে তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি নষ্ট ও বন্ধ থাকা অবস্থায় গ্যাসের চাপে ট্যাংকটি বেইজপ্লেট বরাবর বিস্ফোরিত হয় এবং সেটি ২০ ফুট দূরে ছিটকে পড়ে।
গত ২২ অগাস্ট রাতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী আনোয়ারা উপজেলার ডিএপি সার কারখানার প্রথম ইউনিটে ওই দুর্ঘটনার পর অ্যামোনিয়া গ্যাস ছড়িয়ে পড়লে অসুস্থ হয়ে পড়েন অর্ধশতাধিক মানুষ। আশপাশের ঘেরের মাছ মরার পাশাপাশি গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে যায়। অ্যামোনিয়া মিশে জলাশয়ের পানির রঙ পাল্টে যায়।
দুই কর্মকর্তার গাফিলতির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে তার তদারকি করা হয়নি। বিষয়টি অপারেশন বিভাগ থেকে মেনটেইনেন্স বিভাগে জানানো হলে টেকনিশিয়ান পর্যায়ের কর্মচারী পাঠানো হয়; কোনো কর্মকর্তা সেখানে যাননি।
“তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলে প্রতিষ্ঠানের উপ-প্রধান প্রকৌশলী দিলীপ কুমার বড়ুয়া ও জিএম (ব্যবস্থাপনা) নকিবুল ইসলাম তদারকি করেননি। তারা যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।”
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোমিনুর রশিদ ছাড়াও আনোয়ারার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গৌতম বাড়ৈ ও কর্ণফুলী থানার ওসি রফিকুল ইসলাম এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন।
দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড করপোরেশনের (বিসিআইসি) পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। ওই কমিটি গত রোববার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
ক্ষতি ২৯ কোটি টাকা
ডিএপি-১ এর ট্যাংক বিস্ফোরণে সব মিলিয়ে ২৯ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে জানিয়েছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি।
ক্ষতি হওয়া ট্যাংকের দাম এবং নতুন করে এটি নির্মাণের ব্যয়ও ধরা হয়েছে এর মধ্যে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিস্ফোরণে ধ্বংস হওয়া ট্যাংকের দাম পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা; নতুন ট্যাংক নির্মাণে লাগতে পারে ২২ কোটি টাকার মতো।
এছাড়া কারখানা সংলগ্ন এলাকার পুকুরে এক কোটি ২৭ লাখ টাকার মতো মাছ এবং দুই লাখ টাকার গবাদিপশুর ক্ষতি হয়েছে বলে নিরূপণ করেছে তদন্ত কমিটি।
পাঁচ দফা সুপারিশ
কারখানার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে স্বচ্ছতা আনা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
প্রতিদিনের কাজ পরিচালনায় ক্রয়, মেরামত ও অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শক্তিশালী ‘চেইন অব কমান্ড’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ রয়েছে এর মধ্যে।
এছাড়া ড্যাপ-১ ও ড্যাপ-২ ইউনিটের জন্য নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ও সেইফটি ইউনিট করার সুপারিশ এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।