গ্যাসে মরেছে মাছ-গরু, কারণ খোলসা করেনি কর্তৃপক্ষ

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ডিএপি সার কারখানায় ট্যাংক থেকে নিঃসরিত গ্যাসের প্রভাবে অর্ধশতাধিক মানুষ অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি কারখানা সংলগ্ন কয়েকটি ঘেরের মাছ ও দুটি গরু মারা গেছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2016, 06:21 PM
Updated : 24 August 2016, 07:50 AM

আশপাশের বেশ কিছু গাছের পাতার রংও বদলে গেছে।

এদিকে গ্যাস নিঃসরণকারী ট্যাংকটি ৫০ ফুট দূরে সরে গেলেও সেটি বিস্ফোরিত হয়েছিল নাকি ফুটো হয়ে এ ঘটনা ঘটেছে তা খোলসা করেনি কর্তৃপক্ষ।

ডিএপি সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল কান্তি বড়–য়া এবং বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড করপোরেশনের (বিসিআইসির) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল দুজনের কেউই কীভাবে এ ঘটনা ঘটল তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি।

কারণ খতিয়ে দেখতে কমিটি করা হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন, যদিও ৫০০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া ধারণ ক্ষমতার ট্যাংকটি বিস্ফোরিত হয় বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন।

ঘটনার একদিন পর মঙ্গলবার রাতে আশপাশে গ্যাসের ঝাঁঝ কমে এলেও ঘটনাস্থলে ঝাঁঝালো গন্ধ রয়েছে বলে ওই কারখানার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সোমবার রাতে গ্যাস নিঃসরণ শুরু হওয়ার পর ওই এলাকার পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়লে এর প্রভাবে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

অসুস্থ ৫২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে ৩৮ জন এখনও সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই পংকজ বড়–য়া জানিয়েছেন।

এর বাইরে অনেক মানুষ স্থানীয় আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কাফকো হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

তবে এই গ্যাসের প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিস্ফোরিত ট্যাংক

ট্যাংকের আশপাশে ক্ষয়ক্ষতি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক দানেশ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ গ্যাসের প্রভাবে ক্ষতি তাৎক্ষণিক, দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে না বলে আশা করা যায়।

“যে এলাকায় মাছ বা পশু মারা গেছে তা গ্যাসের তাৎক্ষণিক প্রভাবে হয়েছে বলে ধারণা করছি। নাইট্রোজেনের সাথে অক্সিজেন মিশে বিষাক্ত হয়ে জীবজন্তুর ফুসফুসের ক্ষতি করে।

“এছাড়া পানির সাথে মিশলে এটি অতিরিক্ত ক্ষারীয় হয়ে পড়ে এবং পার্শ্ববর্তী নদী বা জলাশয়ের জলজপ্রাণীর ক্ষতি হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব না থাকার সম্ভাবনা বেশি।”

দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে গেছেন বিসিআইসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল।

“ঘটনা কী কারণে ঘটেছে তা নির্ণয়ে একটি কারিগরি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিলে আমরা বুঝতে পারব।”

দুপুরে সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সহসাই কারণ উদঘাটন করা হবে। এতে কারও গাফিলতি ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এসময় উপস্থিত চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “এটি একটি দুর্ঘটনা। এর সাথে কেউ দায়ী কি না বা কেন ঘটেছে তা তদন্ত শুরু হয়েছে।

“এটি কোনো ‘স্যাবোটাজ’ কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

তবে ঘটনাস্থল ও আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভিন্ন চিত্র।

কারখানা সংলগ্ন একটি মাছের ঘেরের তত্ত্বাবধায়ক রমজান আলী মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মাছ পাহারা দিচ্ছিলাম। রাত ১০টার দিকে ওই কারখানার ভেতর থেকে বিকট তিনটি শব্দ শুনি এবং কালো ধোঁয়া দেখতে পাই। এসময় নাকে ঝাঁঝালো গন্ধও আসে।”

স্থানীয় লোকজন ও কারখানার কয়েকজন কর্মকর্তারা জানান, সোমবার রাতে বিস্ফোরণের পর ডিএপি-১ এর একটি ট্যাংক ৫০ ফুটের মতো দূরত্বে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে। লোহার পাত ও বিশেষ ধরনের উপাদানে তৈরি অ্যামোনিয়া স্টোরেজ ট্যাংকটি ফেটে ভেতরে থাকা গ্যাস নিঃসরণ শুরু হয়।

মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত ট্যাংকটি তার অবস্থান থেকে খানিকটা দূরে কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। 

দুর্ঘটনার পর মাস্ক পরে নিরাপত্তাকর্মীরা

গ্যাসে অসুস্থ একজন

ডিএপি সার কারখানার এমডি অমল কান্তি বড়–য়াও ট্যাংকটি ৫০ ফুট দূরে সরে যাওয়ার কথা বলেছেন।

ঘটনার বিবরণে তিনি বলেন, সোমবার রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। ১৫ মিনিটের মধ্যে বিদ্যুৎ আসে। এরপর ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে ঘটনা ঘটে।

“ট্যাংকটি নিজ জায়গা থেকে ৫০ ফুট দূরে সরে পড়ে যায়। এসময় ট্যাংক ছাড়া আশপাশের অন্য কোনো কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।”

অমল কান্তি জানান, প্রতি রাতে ১০টার দিকে শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কাজের পালাবদল হয়। দুর্ঘটনার সময় ৩০ জনের মতো কাজে যুক্ত ছিলেন।

দুর্ঘটনার পর প্রথমে আটজন, পরে চারজন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে ফায়ার সার্ভিস, কাফকো, সিইউএফএল এর সহযোগিতায় অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়।   

মঙ্গলবার সকালে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের দুই কর্মকর্তা ঘটনাস্থল থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ট্যাংকটি বিস্ফোরণের পর ফেটে গিয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণের কথা বলেন। 

‘বাযুদূষণ সহনীয় পর্যায়ে’

অ্যামোনিয়া গ্যাস ছড়িয়ে কর্ণফুলীর দুই পাড়ের বসতিতে যে বাযু দূষণ হয়েছিল তা ‘সহনীয় পর্যায়ে’ এসেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বিসিআইসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, “ওই এলাকার বাতাসে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ১০০ পিপিএম। দুর্ঘটনাস্থলের ২০০ মিটার দূরে এই মাত্রা ২০ পিপিএম রয়েছে। ওই এলাকার ঝাঁঝালো গন্ধও অনেক কমে এসেছে।’’

“দুর্ঘটনাস্থলে এখনও কিছু পরিমাণ থাকতে পারে। বাকিগুলো নিষ্ক্রিয়করণের কাজ চলছে।”

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএপি কারখানার এক কর্মকর্তা রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধে দুপুর পর্যন্ত অফিস কক্ষে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বসতে না পারলেও বিকাল থেকে তা কমে এসেছে।

“তবে দুর্ঘটনা কবলিত ট্যাংকটির আশেপাশে এখনো গ্যাসের গন্ধের তীব্রতা রয়েছে।”

‘দুটি তদন্ত কমিটি’

গ্যাস নিঃসরণের ঘটনা কীভাবে ঘটল তা জানতে বিসিআইসি ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

বিসিআইসি’র পরিচালক (কারিগরি) আলী আক্কাসকে প্রধান করে ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাদের তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে সিইউএফএল- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু তাহের ভুইয়াকে।

অপরদিকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মমিনুর রশিদকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তাও খতিয়ে দেখবে।

২০০৬ সালে চীনা প্রতিষ্ঠান ‘চায়না কমপ্লান্ট’ ডিএপি কারখানাটি নির্মাণ করে দেয়। এটি প্রতি বছর এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি ডিএপি সার উৎপাদন করে। এ কারখানার দুটি ইউনিটে মোট তিনটি অ্যামোনিয়া গ্যাসের ট্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ‘মাদার’ ট্যাংকের ধারণ ক্ষমতা চার হাজার মেট্রিক টনের বেশি।

অপর দুটি ছোট ট্যাংকের প্রতিটির ধারণ ক্ষমতা ৫০০ মেট্রিক টন করে। ইউনিট-১ এর ছোট ট্যাংকটি সোমবার রাতে ফেটে গিয়ে গ্যাস নিঃসরিত হয়, যেটিতে আড়াইশ থেকে তিনশ মেট্রিক টনের মতো তরল অ্যামোনিয়া ছিল।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, ডিএপি কারখানাটি ২০১০ সালের ২৮ মার্চ পরিবেশগত ছাড়পত্র লাভ করে এবং আগামী বছরের ২৭ মার্চ পর্যন্ত তা নবায়ন করা আছে।