নিঃসরিত গ্যাসের প্রভাবে আনোয়ারায় অবস্থিত ডিএপি কারখানা সংলগ্ন কয়েকটি ঘোনার (মাছ চাষের জন্য বড় পুকুর) মাছ, দুটি গরু মারা গেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশকিছু গাছপালা।
এর বাইরে গ্যাসের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও রসায়নবিদরা বলছেন, অ্যামোনিয়ায় গ্যাস নিঃসরণের ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশ ক্ষতি হয়েছে তাৎক্ষণিক; পরবর্তীতে এর মাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসবে।
সোমবার রাত ১০টার দিকে কর্ণফুলী নদীর তীরে আনোয়ারার রাঙাদিয়ায় চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) লাগোয়া ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সার কারখানার ইউনিট-১ এর অ্যামোনিয়ায় ভর্তি একটি ট্যাংক ফেটে গিয়ে গ্যাস নিঃসরিত হতে থাকে।
এ অবস্থায় কাফকো, সিইউএফএল ও ফায়ার সার্ভিসের দল বিশেষ উপায়ে পানি ছিটিয়ে দিয়ে দুর্ঘটনাস্থলের অ্যামোনিয়ায় গ্যাস নিষ্ক্রিয়করণে কাজ শুরু করে, যা পরবর্তীতে নদী ও ঘোনায় গিয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত একটি ঘোনার তত্ত্বাবধায়ক রমজান মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে বিস্ফোরণের শব্দের পর নাকে ঝাঁঝালো গন্ধ পাই। সকালে গন্ধ পাওয়া না গেলেও সব মাছ মরে ভেসে উঠছে।”
রমজান আলী বলেন, ঝাঝাঁলো গন্ধযুক্ত গ্যাস পুকুরে পড়ায় মাছগুলো মরে গেছে। সেখানে প্রায় ১০ লাখের বেশি টাকার মাছ মরে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।
আশেপাশের লোকজনরে সঙ্গে কথা বলেও মিলেছে পরিবেশে বিরূপ প্রভাবের সত্যতা।
ডিএপি কারখানাটি আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নে হলেও পরিবেশের বেশি ক্ষতি হয়েছে কারখানা সংলগ্ন বারাসাত ইউনিয়নে।
ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাইয়ুম শাহ জানান, গ্যাসের প্রভাবে এলাকায় বেশ কয়েকটি গরু মারা গেছে, গাছপালা নষ্ট হয়েছে। গ্যাসের কারণে তার ইউনিয়নে চারটি ঘোনার প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো মাছ মারা গেছে বলে দাবি করেন তিনি।
ডিএপি সারখানার এমডি অমল কান্তি বড়ুয়াও গ্যাসের কারণে সামনের পুকুরে কিছু মাছ মারা যাওয়া এবং গাছপালা নষ্ট হবার কথা স্বীকার করেছেন।
অ্যামোনিয়ায়যুক্ত পানি নদী বা সমুদ্রে যায়নি দাবি করে অমল কান্তি বলেন, “আমাদের ইটিপি আছে। পানি দিয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিষ্ক্রিয়করণের পর তা পরিশোধনের মাধ্যমে নালা দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে।”
বর্তমানে দুর্ঘটনাস্থল ছাড়া এর আশেপাশের এলাকায় বাতাসে অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঘনত্ব সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে বলেও তার দাবি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট সিনিয়র কামরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ঘটনাস্থলের পাশে নদীর পানি ও বাতাসের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছি। এতে পরিবেশের কি ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণের চেষ্টা করছি।”
অ্যামোনিয়ায়ম গ্যাসের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিধ্যা বিভাগের অধ্যাপক দানেশ মিয়া বলেন, “এ গ্যাসের প্রভাবে ক্ষতি তাৎক্ষণিক, দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে না বলে আশা করা যায়।
“যে এলাকায় মাছ বা পশু মারা গেছে তা গ্যাসের তাৎক্ষণিক প্রভাবে হয়েছে বলে ধারণা করছি। নাইট্রোজের সাথে অক্সিজেন মিশে অক্সাইড তৈরি হয়ে এটি বিষাক্ত হয়ে জীবজন্তুর ফুসফুসের ক্ষতি করে।
“এছাড়া পানির সাথে মিশলে এটি অতিরিক্ত ক্ষারীয় হয়ে পড়ে এবং পার্শ্ববর্তী নদী বা জলাশয়ের জলজপ্রাণীর ক্ষতি হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব না থাকার সম্ভাবনা বেশি।”
এছাড়া সার কারখানা পার্শ্ববর্তী কর্ণফুলী নদীতে নিয়মিত জোয়ার ভাটা থাকায় দ্রবীভূত নাইট্রোজেন দীর্ঘমেয়াদে নদীর পানিতে মিশে থাকবে না বলেও মনে করেন অধ্যাপক দানেশ মিয়া।
এটির ঝাঝাঁলো গন্ধ মানবদেহে প্রবেশ করলে সাময়িক অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেকারণে সোমবার রাতে অনেকেই শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য অসুবিধায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত গ্যাস শরীরে প্রবেশ করলে বেশি ক্ষতি হতে পারত বলেও জানান তিনি।
২০০৬ সালে চীনা প্রতিষ্ঠান ‘চায়না কমপ্ল্যান্ট’ নামক প্রতিষ্ঠান ডিএপি কারখানাটি নির্মাণ করে দেয়।
এতে প্রতি বছর একলাখ মেট্রিক টনের বেশি ডিএপি সার উৎপাদিত হয়; এ কারখানার দুটি ইউনিটে মোট তিনটি অ্যামোনিয়ায় গ্যাসের ট্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে মূল ট্যাংকের ধারণ ক্ষমতা চার হাজার মেট্রিক টনের বেশি।
অপর দুটি ছোট ট্যাংকের প্রতিটিরি ধারণ ক্ষমতা পাঁচশ মেট্রিক টন করে। ইউনিট-১ এর ছোট ট্যাংকটি সোমবার রাতে ফেটে গিয়ে গ্যাস নিঃসরিত হয়, যেটিতে আড়াইশ থেকে তিনশ মেট্রিক টনের মতো তরল অ্যামোনিয়ায় ছিল।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, ডিএপি কারখানাটি ২০১০ সালের ২৮ মার্চ পরিবেশগত ছাড়পত্র লাভ করে এবং আগামী বছরের ২৭ মার্চ পর্যন্ত তা নবায়ন করা আছে।