চট্টগ্রামে হাসিনার জনসভায় গুলির মামলায় পূর্তমন্ত্রীর সাক্ষ্য

চট্টগ্রামে ২৮ বছর আগে শেখ হাসিনার সমাবেশে পুলিশের গুলির মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2016, 07:17 AM
Updated : 24 Jan 2017, 04:00 AM

রোববার চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ মীর রুহুল আমিনের আদালতে এ মামলার ৩৭তম সাক্ষী হিসেবে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন চট্টগ্রামের এই সংসদ সদস্য।

এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাকে জেরা করেন।

মোশাররফ হোসেন তার জবানবন্দিতে বলেন, “শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে সেদিন গুলি চালানো হয়েছিল। উনাকে লক্ষ্য করে চালানো গুলি ভাগ্যক্রমে গায়ে লাগেনি।”

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের আদালত ভবনে যাওয়ার পথে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে আসা নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ২৪ জন নিহত হন। 

সেদিন সেখানে উপস্থিত মোশাররফ বলেন, ‘বিনা উসকানিতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ ঘটানো হয়েছিল সেদিন।

আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “সেদিন সকাল ১১টায় বিমানবন্দর থেকে খোলা ট্রাকে করে নেত্রীকে নিয়ে লালদীঘি মাঠের দিকে আসছিলাম।

“ট্রাকে আখতারুজ্জামান বাবু, আশিকুর রহমান, ইসহাক মিয়াসহ নেতারা ছিলেন। পুরো সড়কজুড়ে ছিল জনস্রোত। বারিক বিল্ডিং মোড়ে আমি ট্রাক থেকে নেমে যাই।”

মোশাররফ বলেন, নিউমার্কেটে পৌঁছে তখনকার জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা সুজনের মোটর সাইকেলে করে তিনি শহীদ মিনারের দিকে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন ট্রাক আর নিউমার্কেট মোড়ে নেই।

“কোতোয়ালি থানার সামনে মোটর সাইকেল থেকে নামি। তখনই পুলিশ আমাকে লাঠিপেটা শুরু করে। ট্রাকটি তখন পুরাতন বাংলাদেশ ভবনের সামনে দাঁড়ানো।”

মোশাররফ বলেন, “সেদিন দেখেছি নেত্রীর সাহস। বিশৃঙ্খলভাবে গুলি করা হয়। তখন ট্রাকে দাঁড়িয়ে মাইকে নেত্রী বলেন- খবরদার, মোশাররফ ভাইকে পেটাবেন না।

“তারা কথা শোনেনি। মারতে মারতে আমাকে নালায় ফেলে দেয়। ‍গুলির শব্দ শুনেছি। পরে আইনজীবীরা গিয়ে মানবঢাল তৈরি করে নেত্রীকে চট্টগ্রাম বারের কার্যালয়ে নিয়ে আসেন।”

জেরায় আসামি পক্ষের আইনজীবী আহাসানুল হক হেনা ১৯৮৮ সালে যার বিরুদ্ধে আন্দোলন সেই এইচ এম এরশাদের সঙ্গে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চান।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ বলেন, “ভোট পাল্টায়, জোট পাল্টায়। উনি (এরশাদ) আমাদের জোটে আছেন। কোনদিন দরখাস্ত দিয়ে ম্যাডাম খালেদা জিয়া আমাদের সাথে চলে আসেন, জানি না।”

১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশেই ওই হামলার ঘটনা ঘটে বলেও আদালতে প্রশ্নের জবাবে বলেন মোশাররফ।

তিনি বলেন, “সে তো পুলিশ অফিসার ছিল। বলব না ইচ্ছা করে করেছে। নির্দেশিত হয়েই করেছে।”

“একটি কথা বলি। এ ধরনের স্বৈরাচারী ভূমিকা বা ঘটনা বাংলাদেশে আর হওয়া উচিত নয়। সবাইকে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া উচিৎ।”

রোববার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী, মহানগর পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী ও সাবেক জেলা পিপি আবুল হাশেম।

মামলায় সাক্ষ্য প্রদান শেষে চট্টগ্রাম আদালত ভবন এলাকায় ১৯৮৮ সালের ঘটনায় নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিফলক দেখিয়ে সেটি সংরক্ষণের দাবি জানান আইনজীবীরা।

এসময় স্থানটি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে আশ্বাস দেন মন্ত্রী।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন জানান, তিন মাস আগে মামলাটি বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তর হয়ে এলে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ, ড. অনুপম সেনসহ ছয়জনের নামে সমন জারি করে আদালত।

এর ধারাবাহিকতায় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেন গত ২৬ মে এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।

সেদিন নিহতরা হলেন- হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম. স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবারট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, মো. শাহাদাত।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওই ঘটনায়।

পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৯৮ সালের ১৪ মে সহকারী পুলিশ কমিশনার হাফিজ উদ্দিন দেওয়ান ৪৭ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।

ওই বছর ৬ সেপ্টেম্বর আদালত সিআইডিকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। ১৯৯৯ সালের ১৪ অক্টোবর সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার কাদের খান সাতজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

অভিযোগপত্রে মীর্জা রকিবুল হুদা, কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল ওরফে জেসি মণ্ডল, কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, মমতাজ উদ্দিন, শাহ মো. আব্দুল্লাহ, বশির উদ্দিনকে আসামি করা হয়।

মামলার আসামি কনস্টেবল বশির উদ্দিন, বাদী অ্যাডভোকেট শহীদুল হুদা এবং শেষ তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার কাদের খান ইতোমধ্যে মারা গেছেন।

অন্যতম আসামি কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক জেসি মণ্ডল দীর্ঘদিন ধরেই পলাতক।