মাহফুজকে নিয়ে ‘উদ্বেগ’, লতিফের বেলায় কোথায় ছিল: মিজানুর

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে একের পর এক মানহানির মামলায় সম্পাদক পরিষদ ও নাগরিক সমাজের একদল প্রতিনিধির উদ্বেগ প্রকাশের সমালোচনা করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2016, 11:28 AM
Updated : 25 Feb 2016, 01:20 PM

তিনি বলেছেন, “এখন আপনারা বলছেন, মামলার কারণে তার (মাহফুজ আনাম) কথার বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে।

“তাহলে একই উৎসাহ আপনারা লতিফ সিদ্দিকীর বেলায় কেন দেখালেন না? তখন প্রশ্ন তোলেননি কেন যে, মত প্রকাশের কারণে তাকে (লতিফ সিদ্দিকী) অপদস্থ ও আটক করা হচ্ছে।”

আবদুল লতিফ সিদ্দিকী (ফাইল ছবি)

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির নতুন চালু হওয়া আইন অনুষদের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন মানবাধিকার কমিশনের এই চেয়ারম্যান।

বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা ‘দুর্নীতির খবর’ যাচাই ছাড়াই প্রকাশ করেছিলেন বলে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক টেলিভিশন আলোচনায় প্রশ্নের মুখে স্বীকার করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম

ওই স্বীকারোক্তির পর আওয়ামী লীগের সমালোচনার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে কয়েক প্রায় একশত মামলা হয় মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে।

বিষয়টিকে ‘স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি’ ও ‘হয়রানি’ আখ্যায়িত করে ইতোমধ্যে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ ও নাগরিক সমাজের একদল প্রতিনিধি। 

অন্যদিকে ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের এক অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে মন্তব্য করায় তখনকার টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে প্রায় দুই ডজন মামলা হয়।

বিভিন্ন ইসলামপন্থি দলগুলোর আন্দোলনের হুমকি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সমালোচনার মুখে মন্ত্রিসভা থেকে সরানোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয় লতিফকে।

আর এসব মামলায় আত্মসমপর্ণের পর ছয়মাসের বেশি কারাগারে থেকে গত বছর জামিন পান লতিফ সিদ্দিকী।

মাহফুজ আনাম (ফাইল ছবি)

‘মামলা দিয়ে মাহফুজ আনামকে হয়রানি করা হচ্ছে’- এমন অভিযোগের জবাবে এসব মামলা কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে ‘অতি উৎসাহী হয়ে’ করছে বলে মন্তব্য করে মিজানুর রহমান বলেন, এতে সরকারের কোনো দায় নেই।

“সাংবাদিকের বিষয়ে যে মামলা- তার জবাবদিহিতা দেওয়ার কর্তৃপক্ষ তো রাষ্ট্র নয়। ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে মামলা করছে।”

“অনেক বিদেশি সংস্থা সরকারের উদ্দেশ্যে বলছে, মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ব্যক্তি মামলা করলে সরকার কি করে প্রত্যাহার করবে? এই যে ধারণা, সরকার কাউকে দিয়ে মামলা করাচ্ছে সেটাই তো অমূলক।,” বলেন এনএইচআরসি চেয়ারম্যান।

মিজানুর রহমান বলেন, “তিনি (মাহফুজ আনাম) নিজেই বলেছেন অসত্য ও বিকৃত তথ্য দেওয়া হয়েছিল। সেজন্য ক্ষমা চেয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

“কিন্তু সেই মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় যাদের হয়রানি হয়েছে- তাদের প্রতিকারের বিষয়টিও ভাবা দরকার। বিচারাধীন মামলা আদালতের এখতিয়ার। আইনি প্রক্রিয়ায় তা এগুবে।”

এরশাদকে চেয়ার কেন?

এর আগে বেসরকারি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের উদ্বোধনী বক্তব্যে বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থাকে ‘ধনী বান্ধব ও দরিদ্র বিরোধী’ বলে মন্তব্য করেন মিজানুর রহমান।

মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, “আইনে বলা আছে- দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে নির্দোষ গণ্য করতে হবে। সেই নির্দোষ ব্যক্তিদের প্রতি কী আচরণ আমরা করছি?

“হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে আদালত কক্ষে চেয়ার দেওয়া হয়। বলা হয়- আপনার বয়স হয়েছে, বসে বলুন। সাধারণ মানুষের বয়স হয় না? তাদের কি চেয়ার দেওয়া হয়? সারাদিন দাঁড় করিয়ে রেখে গোধূলী বেলায় বলা হয়- আজ হবে না। চলে যান।”

মিজানুর বলেন, “আইনের বইয়ে সম আচরণের কথা বলা হয়েছে। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের সাথে প্রতারণা করছি। এদেশের দরিদ্র মানুষ সোনার মত পবিত্র।

“সেই মানুষকে যদি আইন ব্যবস্থা রক্ষা করতে না পারে তাহলে ধিক- সেই আইন ব্যবস্থাকে, সেই আইনজীবীকে এবং সেই আইন শিক্ষাকে।”

বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সমালোচনা করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, “কথা বলার স্বাধীনতা আছে বলেই বলব- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছে কী না জানা নেই? এটা রাবিশ, এগুলো বলার সময় পার হয়ে গেছে। এ ধরনের দুঃসাহস কি করে কেউ দেখায়?”

অনুষ্ঠান শেষে প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, “ঐতিহাসিক কিছু সত্য সমগ্র জাতি সত্য হিসেবে গ্রহণ করে। ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য অপ্রতিষ্ঠিত (আনসেটলড) করার চেষ্টা দুরভিসন্ধিমূলক।

“আমাদের সংবিধানে শহীদদের সংখ্যা উল্লেখ আছে। সেই সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ নিয়ে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ও সংসদে গিয়ে কেউ কি করে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এটা সংবিধানকে অবজ্ঞা করার সামিল।”

চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য ড. ইরশাদ কামাল খানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনীতে নেপালের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও কাঠমান্ডু স্কুল অব ল’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. যুবরাজ সাংগ্রুলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সমন্বয়ক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন, প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক এম নুরুজ্জামানসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।