মাশরাফির নতুন চ্যালেঞ্জ

ক্যারিয়ার জুড়ে মাঠের ভেতরে-বাইরে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ জিতেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। এখন বাংলাদেশ অধিনায়ক মুখোমুখি নতুন একটি চ্যালেঞ্জের – দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে টানা তিন ম্যাচে হারা সতীর্থদের উজ্জীবিত করা, দলকে জয়ে ফেরানো।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2015, 10:13 AM
Updated : 11 July 2015, 03:48 PM

বাংলাদেশের নেতৃত্বে এবারের দফায় মাশরাফির মধুচন্দ্রিমা দীর্ঘায়িত হয়েছিল অনেকটাই। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে জিম্বাবুয়েকে ৫-০ ব্যবধানে হারানো দিয়ে শুরু। হতাশায় মোড়ানো বাংলাদেশ ক্রিকেটের ২০১৪ সাল শেষ হয়েছিল জয়ে ফেরার স্বস্তিতে। এরপর বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডের কন্ডিশনে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়ে তার দল খেলেছে কোয়ার্টার-ফাইনালে। ১৬ বছর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের স্বস্তি পরে রূপ নিয়েছে হোয়াইটওয়াশ করার বাধভাঙা আনন্দে। এই স্রোতে জয় মিলেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতেও। সেই সাফল্যের রেশ থাকতে থাকতেই ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়। প্রতিদিনই নিজেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট।

এই সাফল্যের মূল কারিগর মানা হচ্ছিল মাশরাফিকে। অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বে বাংলাদেশ দলের খোলনলচেই পাল্টে দিয়েছিলেন মাশরাফি। নুয়ে পড়া শরীরী ভাষার দলটির ভেতরে বুনেছিলেন আগ্রাসনের বীজ। দলকে করে তুলেছিলেন জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত। 

এরপরই ছন্দপতন। অধিনায়ক মাশরাফির এই মধুচন্দ্রিমা একটা সময় শেষ হতোই। সেই সময়টা এল এই দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে। দুটি টি-টোয়েন্টিতে হারের পর প্রথম ওয়ানডেতেও পাত্তা পায়নি বাংলাদেশ। মাত্র এই তিন হারেই অবশ্যই আবার দু:সময়ের বলয়ে পড়ে যাচ্ছে না বাংলাদেশ। তবে শঙ্কা জাগাচ্ছে হারের ধরনটা। একটি ম্যাচেও লড়াই করতে পারেনি বাংলাদেশ। বলা ভালো, লড়াই করার মানসিকতাটাই দেখাতে পারেনি মাঠে। শরীরী ভাষায় সেই বারুদ যেন উধাও। মনে হয়েছে, ক্লান্ত-শ্রান্ত একটি দল। ব্যাটিংয়ে ছিল না পরিকল্পনার ছাপ। দেখা গেল সেই আগের মতো থিতু হয়ে উইকেট ছুঁড়ে আসা এবং দৃষ্টিকটু শটে উইকেট বিলিয়ে আসার প্রতিযাগিতা।

প্রশ্নবিদ্ধ দলের একাদশ সাজানোও। বরাবরই যে মাশরাফির কণ্ঠে আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের জয়গান, যা গত কিছু দিনেই হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ‘ব্র্যান্ড’, সেই মাশরাফিই শুক্রবার প্রথম ওয়ানডেতে ৪০ ওভারের ম্যাচে একাদশ সাজিয়েছেন ৮ ব্যাটসম্যান নিয়ে!

দল জিততে থাকলে চোখে পড়ে না অনেক কিছুই। হারলে বেরিয়ে আসে অনেক গলদ। একজন অধিনায়কের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই সময়টাতেই। দল হারতে থাকলে ক্রিকেটারদের মনে ঢুকে যায় শঙ্কা, সংশয়। নড়ে যায় আত্মবিশ্বাস, প্রশ্ন জাগে নিজের সামর্থ্য নিয়েই। প্রক্রিয়াগুলোও তখন আর ঠিক থাকে না। অধিনায়কের চ্যালেঞ্জ, সবার মন থেকে ওই সংশয়গুলো দূর করার। আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার। দলকে উজ্জীবিত করা, লড়াই করার শক্তি ও সাহস জোগানোর। অধিনায়ক মাশরাফির সামনেও এখন এই চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে যত ওলট-পালটই হোক, একটা ব্যাপার প্রায় অবিনশ্বর, চ্যালেঞ্জ নিতে কখনো ভয় পান না মাশরাফি। তার ক্যারিয়ারটাই তো অসম্ভবকে সম্ভব করা গল্প, অসংখ্য চ্যালেঞ্জ জয় করার উদাহরণে ঠাসা। মাশরাফি ভয় পাচ্ছেনও না। সময়টা চ্যালেঞ্জিং, তিনি মানছেন। এবং চ্যালেঞ্জটাও নিচ্ছেন। শুক্রবার প্রথম ওয়ানডে শেষে এই চ্যালেঞ্জ জয়ের প্রত্যয় শোনালেন নিজের জীবনে অভিজ্ঞতা থেকেই।

“অবশ্যই এটা একটা চ্যালেঞ্জ। দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া এমনিতেই সবসময় চ্যালেঞ্জিং। আরও বেশি চ্যালেঞ্জ যখন দল হারের ভেতর ঢুকে যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি এর চেয়েও অনেক বড়, অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ জিতেছি। এসবে আমি ভয় পাই না।”

ভয় পান না, কারণ চ্যালেঞ্জ মাশরাফি উপভোগ করেন। চ্যালেঞ্জ উপভোগ করেন, কারণ এতে তিনি রোমাঞ্চিত হন।

“চ্যালেঞ্জ মানেই হলো উত্তেজনা। চ্যালেঞ্জ জয় করে ঘুরে দাঁড়ানোর মজাই অন্যরকম। আমরা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ জিতব। আজ দিন ভালো যাচ্ছে না, কালই হয়ত ভালো যাবে।”

মাশরাফির চ্যালেঞ্জটা আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই চ্যালেঞ্জ। পরের ধাপে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেটীয় শক্তির তারতম্য থাকলেও এই দুই দলের ধরন, ক্রিকেট দর্শন প্রায় কাছাকাছিই, যেটা বাংলাদেশের অনেকটাই চেনা। দক্ষিণ আফ্রিকা উল্টো ক্রিকেট দর্শন মেনে চলা দল। আপাদমস্তক পেশাদার একটি দল, যারা ক্রিকেটীয় প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করার ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দেয় না। প্রস্তুতিতে ঘাটতি রাখতে চায় না একটুও। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ভারত বাংলাদেশে এসে অনুশীলন করেনি বেশ কদিন। ম্যাচ খেলার পর দিন তো করেইনি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশে পা রাখার পর একটি দিনও অনুশীলন করা বাদ দেয়নি।

সিরিজ শুরুর আগে থেকে মাশরাফি বলে আসছিলেন, ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কঠিন হবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো। মাঠের ক্রিকেটেও সেটারই প্রতিফলন দেখা গেল। তবে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি এখনই। শেষ দুই ম্যাচ জিতে এখনও সিরিজ জিততে পারে বাংলাদেশ। ভারত-পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রমাণ অবশ্যই রেখেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারলে বলা যাবে, পা রাখল পরবর্তী ধাপে!

না জিতলেও অন্তত লড়িয়ে মানসিকতার প্রমাণ রাখার সুযোগ তো আছেই। অধিনায়ক মাশরাফির চ্যালেঞ্জ এটিই। তিনি নিজেই তো কিছুদিন আগে বলেছেন, চ্যালেঞ্জ যত কঠিন, জিতলে তত বেশি মজা!

আর মাশরাফি এই চ্যালেঞ্জে জিতলে জিতবে বাংলাদেশের ক্রিকেটও।