মিরপুর স্টেডিয়ামে সাংবাদিক লাঞ্ছিত, ক্ষমা চাইল বিসিবি

বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ শুরুর আগের দিন মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বিসিবির নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক সেকান্দার আলি। পরে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2015, 04:21 PM
Updated : 5 July 2015, 06:00 AM

এক সময়ের জাতীয় হকি খেলোয়াড় ও বর্তমানে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ-এ কর্মরত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সেকান্দার শনিবার সকালে বাংলাদেশ দলের অনুশীলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সেকান্দার আলি বলেন, “শের-ই-বাংলার ইনডোর থেকে মূল মাঠে আসার করিডোরে দাঁড়িয়ে আমি দলের ফিল্ডিং অনুশীলন দেখছিলাম। হঠাৎ দুজন নিরাপত্তাকর্মী এসে আমার অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখতে চান। আমি বলি যে কার্ড এখনও দেওয়া হয়নি বিসিবি থেকে। আমি অফিসের আইডি কার্ড দেখাই। তবু তারা জেরা করতে থাকে।”

এক পর্যায়ে সেখানে এসে যোগ দেন একজন পুলিশ সদস্য।

“পুলিশ সদস্য এসে আমাকে বলতে থাকে যে ‌‘আপনার আচরণ সন্দেহজনক।’ আমি বারবার বলেছি যে আমি প্রতিদিনই স্টেডিয়ামে আসি পেশাগত কাজে। কিন্তু তারা কান দেননি। বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ওই পুলিশ সদস্য আমাকে সজোরে ধাক্কা মারেন। ছিটকে গিয়ে গ্যালারির গ্রিলের সঙ্গে আমি আছড়ে পড়ি। হাতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছি।”

যে নিরাপত্তাকর্মীরা একজন সাংবাদিককে হেনস্থা করেছেন, তাদের নিজেদেরই কারও অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ছিল না। কারণ রোববার সিরিজ শুরু হলেও বিসিবি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দিয়েছেই শনিবার দুপুরে! অভিযুক্ত ওই নিরাপত্তাকর্মীদের একজন পরে বিসিবির প্রধান নিবার্হীর কক্ষে ক্ষুব্ধ সংবাদকর্মীদের সামনে স্বীকার করেছেন, সেকেন্দার আলিকে তিনি চিনতে পেরেছেন। তারপরও ওই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে।

পরে ঘটনার জন্য দু:খপ্রকাশ করেছে বিসিবি। বিসিবি পরিচালক ও মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস বলেন, “আমরা দু:খিত যে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনা কখনোই কাম্য নয়। আমরা নিশ্চিত করব, যেন এমন কিছু ভবিষ্যতে আর কখনও না হয়।”

কিন্তু এই ধরণের হেনস্থা-হয়রানি ও দু:খপ্রকাশ নতুন নয়। ক্রিকেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম মনে করিয়ে দিলেন সেটাই।

“২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচের সময় চট্টগামে ক্রীড়া সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের ন্যাক্কারজনক হামলা খবরের শিরোনাম হয়েছিল বিশ্বজুড়েই। ওই ঘটনার পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল বেশ। তবে টুকটাক ঘটনা প্রায়ই ঘটে। গত কিছুদিনে সেটা আবার বেড়েছে। অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড থাকার পরও আমি নিজে অনেকবার হেনস্থা হয়েছি, অনেককে হতে দেখেছি।”

বিসিবির নিরাপত্তা উপদেষ্টা হোসেন ইমাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বাইরেও বিসিবি ৮০ জন্য নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

বিসিবি একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও প্রতি সিরিজেই কেন এত বাইরের নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিতে হয়, সেই প্রশ্ন তুললেন দৈনিক কালের কণ্ঠের ক্রীড়া সম্পাদক ও বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসজেএ) সভাপতি এটিএম সাইদুজ্জামান।

“বিসিবিতে প্রায় দেড়শ’ স্টাফ আছেন। তার পরও প্রতি সিরিজেই অতিথি পাখির মত নিরাপত্তাকর্মীর প্রয়োজন হলে এই স্টাফদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। আমি অনেক দেশে ক্রিকেট কাভার করেছি। দেখেছি গুটিকয়েক লোক মিলেই একেকটা বড় বড় সিরিজ সুনিপুণভাবে আয়োজন করেছে।”

প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্রিকেট কাভার করে আসা এই সিনিয়র সাংবাদিকও জানালেন, এই ধরণের ঘটনা বারবারই ঘটছে।

“এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং ধারাবাহিকভাবে চলে আসা ঘটনারই অংশ মাত্র। আমরা যারা ক্রিকেটের সংবাদ সংগ্রহ করতে প্রায় প্রতিদিন বিসিবিতে আসি, সিরিজ ছাড়া অন্য সময় কখনই কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক সিরিজ হলেই এই মৌসুমী নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে হেনস্থা হওয়ার ঘটনা ঘটে প্রায়ই।”

এই নিরাপত্তাকর্মীদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ বরাবরই। বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুসই যেমন স্বীকার করলেন, নিরাপত্তাকর্মীদের সবাই যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নয়।

অভিযোগ আছে, এই নিরাপত্তাকর্মীদের প্রায় সবার নিয়োগই রাজনৈতিক। তাছাড়া বিসিবি কর্তাদের আত্মীয়-পরিজনদেরও জায়গা হয় এখানে। নিরাপত্তাকর্মীরাই আসলে নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি, এমন অভিযোগও আছে অনেকের।

মোহাম্মদ ইসাম যেমন বললেন, “আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, নিরাপত্তার ব্যাপারে খুব সামান্যই ধারণা আছে এই নিরাপত্তাকর্মীদের। নিজের কাজ সম্পর্কে ধারণা নেই, পরিধি জানা নেই। তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড, বাছাই প্রক্রিয়া নিয়েও যথেষ্ট সংশয়ের অবকাশ আছে। প্রায় সবারই আচরণ খুব উদ্ধত। সাধারণ দর্শকের সঙ্গেও তারা উদ্ধত আচরণ করে প্রায়ই।”

এই নিরাপত্তাকর্মীদের মূল দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মেলে প্রায়ই। ভারতের বিপক্ষে গত মাসের ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে যেমন ম্যাচ শেষে মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন শত শত দর্শক। মাঠ জুড়ে, এমনকি উইকেটে গিয়ে ছবি, সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। অনেকে ঢুকে পড়েছিলেন ড্রেসিংরুমের সামনেও। শুধু তাই নয়, ক্রিকেটারদের জাপটে ধরে, পথ আটকে, টানাটানি করে সেলফি তোলার হিড়িকও দেখা গেছে। যাতে রীতিমত বিব্রত ক্রিকেটাররা।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে এটা নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও।

“শেষ কয়েকটা ম্যাচে দেখেছি, মাঠে অনেক দর্শক ঢুকে গিয়েছে। হয়তো বাইরে থেকে চলে এসেছে। আমরা তো বটেই, বাইরের খেলোয়াড়রাও এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। তাদের কাছে মনে হতে পারে, ‌‘এসব আবার কেমন’? এগুলো আগে কখনো হয়নি, কিছুদিন ধরেই আমি দেখছি। অবশ্যই নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের খেয়াল করা উচিত।”

সংবাদকর্মী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাতেও মর্মাহত বাংলাদেশ অধিনায়ক।

“এসব কখনোই কাম্য নয়। কাউকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। আমি চাই এ ধরণের ঘটনা আর কখনোই না ঘটুক।”