কালো মেঘ সরিয়ে আলোয় জুবায়ের

৪ উইকেট নিয়ে দিনের সফলতম বোলার সাকিব আল হাসান। কিন্তু ফতুল্লা টেস্টের তৃতীয় দিনে রোদ-মেঘ-বৃষ্টির মাঝে আলাদা দ্যুতি ছড়িয়েছেন জুবায়ের হোসেন।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2015, 01:43 PM
Updated : 13 June 2015, 06:06 AM

১৯-১-১১৩-২ - আপাতদৃষ্টিতে সাদামাটা একটি বোলিং বিশ্লেষণ। দুটি মোটে উইকেট, টেস্ট ক্রিকেটেও ওভারপ্রতি রান ছয় ছুঁইছুঁই। কিন্তু যারা খেলা দেখেছেন, তাদের কাছে দিনশেষে স্কোরকার্ডকে ‘আস্ত বোকাই’ মনে হবে।

৪ উইকেট নেওয়া সাকিব বা শতক করা মুরালি বিজয় নন, ফতুল্লা টেস্টের তৃতীয় দিনে সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চ জাগিয়েছেন জুবায়ের হোসেন। তার এই আপাত বিবর্ণ বোলিং বিশ্লেষণেই লুকিয়ে দিনের সবচেয়ে ঝলমলে অধ্যায়।

ছন্দে থাকা একজন লেগ স্পিনার তার ভাণ্ডারের যাবতীয় অস্ত্রের পসরা ২২ গজে মেলে ধরলে এর চেয়ে রোমাঞ্চকর দৃশ্য ক্রিকেটে খুব কমই দেখা যায়। জুবায়ের এদিন তার সব সৌন্দর্য্য নিয়ে উপস্থিত হলেন। অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন বলেছিলন, ‘ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা ঘুমিয়েও স্পিন খেলতে পারে’; সেই ভারতীয়দেরই দিনভর ভোগালেন জুবায়ের।

১৯ ওভারে ওই ১১৩ রান দেওয়ার ব্যাপারটি এক পাশে থাকুক। লেগ স্পিনাররা এমনিতে প্রায়ই একটু খরুচে হন। জুবায়ের সেখানে মাত্রই ১৯ বছরের এক লেগ স্পিনার, সবে ৩ টেস্ট ও ১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচের অভিজ্ঞতা। কাজেই তার হাত থেকে বল ফসকাবে, মাঝেমধ্যেই ফুল টস-লং হপ হবে, কিছু এলোমেলো ডেলিভারি হবে। নিয়ন্ত্রণের কঠিন শিল্পটি রপ্ত করতে আরও সময় লাগবে। স্টক ডেলিভারি গুগলির অতি ব্যবহারের লোভটা সামলাতেও শিখতে হবে।

তবে ওসব শিক্ষা তোলা থাক সময়ের হাতে। আপাতত ওই ফূলটসগুলোকে ভুলিয়ে দিচ্ছে দারুণ সব লেগব্রেক, তার টার্ন-বাউন্স-লুপ। ব্যাটসম্যানকে মন্ত্রমুগ্ধ করে টেনে আনা, গুগলিতে ব্যাটসম্যানের চেহারা হতভম্ব করা- জুবায়েরের অপরিপক্কতা আড়াল হয়ে যায় তার সহজাত প্রতিভা আর সামর্থ্যে।

প্রথম দিনে জুবায়ের ছিলেন একদম বিবর্ণ। ৭ এভারে ৪১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য। বল ফেলার জায়গাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। মাঝে বৃষ্টিতে হারিয়ে যাওয়া একটি দিনে হারিয়ে গেছে জুবায়েরের জড়তাও। তৃতীয় দিনে প্রথম বলটিতেই পূর্বাভাস দারুণ কিছুর। ফ্লাইটে টেনে আনলেন বিরাট কোহলিকে, টার্ন-বাউন্সে ভারত অধিনায়ক পরাস্ত। অল্পের জন্য ব্যাটের কানা নেয়নি বল। দুই বল পরেই গুগলি। একটু হকচকিয়ে যাওয়া কোহলি মুচকি হেসে মাথা নাড়লেন, যেন বলতে চাইলেন, ‘ওয়েল বোল্ড!’ একটু পরই কোহলির হাসি উধাও আরেকটি গুগলিতে।

আউট হওয়ার আগের বলটিতেই জুবায়েরকে কাভার ড্রাইভে চার মেরেছিলেন কোহলি। সেটি ছিল বোধহয় জুবায়েরের ‘সেট আপ’, শিকারের ক্ষেত্র তৈরি করা। পরের বলটি আবার ফ্লাইট দিয়ে অফ স্টাস্পের সামান্য বাইরে। আবারও লেগ ব্রেক মনে করে কাভার ড্রাইভই করেছিলেন কোহলি। কিন্তু বলটি তো ছিল গুগলি! কোহলির ব্যাটের কানা ছুঁয়ে প্যাডে চুমু দিয়ে বল স্টাম্পে!

জুবায়েরের দ্বিতীয় উইকেটটি তো সম্ভবত এই টেস্টের সবচেয়ে মুগ্ধতা ছড়ানো অধ্যায়। আবারও মোহ জাগানিয়া ফ্লাইট, একদম জায়গামতো পিচ, ব্যাটসম্যানকে শটে প্রলুব্ধ করে, ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড-নিখুঁত গুগলি। ঋদ্ধিমান সাহা হয়ত আউট হওয়ার হতাশা অনেকটাই ভুলে গেছেন; ড্রেসিংরুমে গিয়ে যখন দেখেছেন ওই বলের ভিডিও!

দুটি উইকেট পেয়েছেন। অনায়াসেই পেতে পারতেন আরও ২-৩টি। দিনের সম্ভবত সেরা ডেলিভারিতেই উইকেট পাননি। ওই গুগলির জবাব জানা ছিল না হরভজন সিংয়ের, কিন্তু অল্পের জন্য স্পর্শ করেনি অফ স্টাম্প। চোখ ধাঁধানো কিছু ডেলিভারি ছিল আরও।

এই মুগ্ধতা, বিস্ময়ের পাশাপাশি চলে আসে দীর্ঘশ্বাস, আক্ষেপ। এই তুমুল প্রতিভাবান ছেলেটিকেও গত কিছুদিন ধরে ম্যাচ খেলার জন্য হাপিত্যেশ করে বেড়াতে হয়েছে! প্রতিভার প্রামাণ্য চিত্র দেখিয়েছিলেন তিনি অভিষেক সিরিজেই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই সিরিজে জুবায়েরকে দেখে বলাবলি হচ্ছিল সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। হায়, এই ঘরের লক্ষীকে ঠেলা হলো পায়ে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে দিনের পর দিন পানি আর তোয়ালে টেনেই দিন পার। জাতীয় দলের নির্বাচকদের আর টিম ম্যানেজমেন্টের কাছেও আচমকাই ব্রাত্য। পাকিস্তান সিরিজেও একাদশের বাইরে। একজন তরুণ লেগ স্পিনারের উন্নতি করা আর পরিণত হওয়ায় ম্যাচ খেলার বিকল্প নেই। যত বেশি সম্ভব ম্যাচ খেলা। অথচ জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর গত সাড়ে ছয় মাসে জুবায়ের খেলেছেন মাত্র ৭টি ম্যাচ।

এই সময়ে মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের কারণেই বেশি আলোচিত জুবায়ের, যেটায় তার দায় ছিল না এতটুকুও। তাকে দলে চেয়ে কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহের প্রকাশ্য ঘোষণা; আর তাতে প্রধান নির্বাচকের সায় না থাকা। এই সিরিজের দল ঘোষণার সময়ও প্রধান নির্বাচক জানিয়েছিলেন, কেবল কোচ-অধিনায়কের চাওয়াতেই দলে জুবায়ের। একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে কোচ ও নির্বাচকদের এমন প্রকাশ্য টানাপোড়েন বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিরল।

কোথায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর জুবায়েরকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করা হবে; ওয়ার্ন বা ম্যাকগিলের মতো কাউকে না পাওয়া যাক, অন্তত হাতের কাছের আবদুল কাদির বা ভগবত চন্দ্রশেখরের কাছে টিপস বা কোচিং সেশনের ব্যবস্থা করা হবে; কিন্তু হলো উল্টো। কোচ আর প্রধান নির্বাচকের টানাপোড়েনের জাঁতাকলে পড়ে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত জুবায়েরের।

জুবায়ের তবু হারেননি। প্রথম দিনের বিবর্ণ চেহারা ছিল কেবল ম্যাচ অনুশীলনের অভাবের প্রভাব। একদিন পরই তিনি সব কালো দূর করে আপন আলোয় আলোকিত। দিনশেষে সাকিব আল হাসানের কণ্ঠে তাই আকুতি, “জুবায়েরকে সময় দিন, ওকে নিয়ে ধৈর্য ধরুণ।”

আকুতিটা এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটেরও, বাংলাদেশের ক্রিকেটের নীতি-নির্ধারকদের কাছে।