ভারত বলেই স্মৃতিকাতর মাশরাফি

আঙিনায় যখন ভারত, মাশরাফি বিন মুর্তজাকে তখন মনে পড়বেই। রঙিন পোশাকে জ্বলে উঠেছেন বারবার, সাদা পোশাকেও ক্যারিয়ার সেরা সিরিজ ভারতের বিপক্ষেই। এখন তিনি টেস্ট ক্রিকেটের জগত থেকে অনেক দূরে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সফলতম টেস্ট পেসার ফিরে তাকালেন তার টেস্ট ক্যারিয়ারে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2015, 05:50 PM
Updated : 8 June 2015, 06:06 PM

২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে ব্যাটে-বলে দারুণ এক সিরিজ কাটিয়েছিলেন। ওই সিরিজে ফিরে তাকালে প্রথমেই কোনটি মনে পড়ে?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: শুরুতেই মনে পড়ে ৫ উইকেট পাওয়ার একটা সুযোগ ছিল, চট্টগ্রামে। ধোনিকে আউট করে চতুর্থ উইকেট নিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ওরা ডিক্লেয়ার করে দিল। মেজাজটা বিগড়ে গিয়েছিল। পরে ব্যাটিংয়েও ভালো করেছিলাম। আমি আর রাজীব (শাহাদাত হোসেন) মিলে ফলোঅন বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম। নবম উইকেটে একশ’ রানের মত (৭৭) জুটি গড়েছিলাম আমরা। আমি করেছিলাম ৭৯।

দ্বিতীয় ইনিংসে আমরা দারুণ বোলিং করেছিলাম। ১০০ রান তুলতেই ওদের ৬ উইকেট পড়ে। পরে তো বৃষ্টিতে খেলাই হলো না। পরে ঢাকা টেস্টেও ৭০ করলাম।

সিরিজের প্রথম বলেই ওয়াসিম জাফরকে বোল্ড করা মনে পড়ে না?

মাশরাফি: মনে পড়বে না আবার! মজার ব্যাপার হলো, আমার শরীরটা সেদিন খুব ভালো ছিল না। অনেক দিন পর আমরা টেস্ট খেলতে নেমেছিলাম, আমার ছোটখাটো চোট ছিল। কিন্তু প্রথম বলটি করার জন্য যখন ছুটলাম, আমার মনে হচ্ছিল, প্রথম বলেই উইকেট পেয়ে যাব। কি কারণে জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছিল। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, উইকেটের ছবিটাও আমার চোখে ভাসছিল। আমি অফ স্টাস্পে বল ফেলব, কাট করে ভেতরে ঢুকবে। ব্যাটসম্যান ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হবে। অদ্ভুত ভাবে হুবহু সেটাই হলো। ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হলো ওয়াসিম জাফর।

তবে ওই যে বললাম, সেদিন শরীরটা ভালো ছিল না। প্রথম বলের পর আর ভালো বোলিং করতে পারছিলাম না (৫ ওভারের প্রথম স্পেলে রান দিয়েছিলেন ৩৮)। লাঞ্চের পর আবার বোলিং ভালো হয়েছিল। ৫-৬ ওভারের একটা স্পেল করেছিলাম, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ব্যাটসম্যান ঠিক মতো খেলতে পারছিল না। পরে ডেভ (হোয়াটেমোর, সেই সময়ের কোচ) বলেছিল, প্রথম বলে উইকেট না পেলেই তোমার ভালো হতো…হাহাহাহা।

ওই ভারত সিরিজটাকেই কি ক্যারিয়ারের সেরা টেস্ট সিরিজ বলবেন?

মাশরাফি:
ব্যাটিং-বোলিং মিলিয়ে বললে ওটাই সেরা সিরিজ। তবে শুধু বোলিংয়ের কথা বললে সেরা ২০০৩ সালের ইংল্যান্ড সিরিজ। ঢাকায় ২ ইনিংসে ৪ উইকেট পেয়েছিলাম, পরে চট্টগ্রামে এক ইনিংসেই চারটি। শুধু উইকেট সংখ্যার কারণে নয়, ওই সিরিজ আমার কাছে সেরা, যেভাবে বোলিং করছিলাম সেই কারণে। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপে তখন ট্রেসকোথিক-ভন-বুচার-হুসেইন-থর্প। কেউ পুরো সিরিজে আমার বল ঠিকমত খেলতে পারেনি। চট্টগ্রামে ৫ উইকেট হয়েই যেত, আম্পায়ার একটা কটবিহাইন্ড দিল না।

অভিষেক টেস্টেই ৪ উইকেট পেয়েছিলেন, পরে ৪ উইকেট পেয়েছেন আরও তিনবার। কিন্তু একবারও ৫ উইকেট নেই, আক্ষেপ হয় না?

মাশরাফি: আক্ষেপ বলতে…হ্যাঁ, একটু তো আছেই। ৫ উইকেট তো একটা মাইলফলক। তবে নিয়মিত খেলতে পারলে অবশ্যই পেতাম ৫ উইকেট। ৮ বছর খেলেছি, তবে ইনজুরিসহ নানা কারণে নিয়মিত খেলতে পারিনি। তখন আমাদের দলও বেশি ভালো করতে পারেনি। খেলেছি ৩৬ টেস্ট, কিন্তু খুব কম টেস্টেই আমরা দুই ইনিংস বোলিং করার সুযোগ পেতাম। আবার দেখা যেত আমার উইকেট ৩ বা ৪টি হযেছে, তখনই প্রতিপক্ষ ইনিংস ডিক্লেয়ার করেছে। সব মিলিয়ে হয়নি। তারপরও ৩৬ টেস্ট খেলে ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়া উচিত ছিল। কিন্ত ক্যারিয়ারে যতবার আমি ফর্মের চূড়ায় উঠেছি, ততবারই কোনো না কোনো ইনজুরিতে ছিটকে পড়েছি। তখন আবার সেই রিহ্যাব, আবার ফেরা, ফর্ম খুঁজে পাওয়ার লড়াই…।

একবারও ইনিংসে ৫ উইকেট না পেয়ে সর্বোচ্চ টেস্ট উইকেট:

বোলার

ম্যাচ

উইকেট

সেরা

মাইক হেনড্রিক (ইংল্যান্ড)

৩০

৮৭

৪/২৮

মাশরাফি মুর্তজা (বাংলাদেশ)

৩৬

৭৮

৪/৬০

ব্রায়ান ম্যাকমিলান (দ.আফ্রিকা)

৩৮

৭৫

৪/৬৫

ডেল হ্যাডলি (নিউজিল্যান্ড)

২৬

৭১

৪/৩০

ব্যারি নাইট (ইংল্যান্ড)

২৯

৭০

৪/৩৮

ওই ভারত সিরিজে ব্যাটিংটা এত ভালো করেছিলেন কিভাবে?

মাশরাফি: আত্মবিশ্বাসটা পেয়েছিলাম ওই বছর বিশ্বকাপ থেকে। বিশ্বকাপে বেশ ভালো ব্যাটিং করেছিলাম। অস্ট্রেলিয়ার সাথে ম্যাকগ্রা-টেইট-ব্র্যাকেনকে খেলে রান পেযেছিলাম (১৭ বলে ২৫)। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারালাম যে ম্যাচে, মাখায়া এনটিনিকে মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা মেরেছিলাম, পোলক-নেলদেরও ভালো খেলেছিলাম (১৬ বলে ২৫)। তবে সত্যিকারের আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলাম বারবাডোজের দুটি ম্যাচ থেকে। ওখানে উইকেট সবসময়ই বাউন্সি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওখানে ২০ ওভারেই আমাদের ৬ উইকেট পড়ল। আমি নেমে অনেকক্ষণ ছিলাম ক্রিজে (৫১ বলে ৩৭)।

তবে সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং করেছিলাম ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে। বারবাডোজের উইকেটে অ্যান্ডারসন-ফ্লিনটফদের বোলিংয়ে সেদিন ১৫ ওভারে আমাদের ৬ উইকেট পড়ার পর নেমেছিলাম আমি। রান করেছিলাম মাত্র ১৩, কিন্তু অনেক সময় ছিলাম উইকেটে। সাকিবের সঙ্গে একটা জুটি হয়েছিল। সাকিব ফিফটি করল, আমি একপাশে আগলে ছিলাম। পরে ইয়ান বেল আমাকে এসে বলেছিল, “একমাত্র তোমাকেই দেখলাম বলের লাইনে গিয়ে খেলতে। তুমি এত নিচে ব্যাটিং করো কেন, তুমি তো তোমার দলের সেরা ব্যাটসম্যান।”

ওই ব্যাটিং থেকেই আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলাম, ভারত সিরিজে সেটাই কাজে লেগেছিল। পরে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে আবার ব্যাটিংয়ে খারাপ করি। কারণ স্পিন বল আমি বোলারের হাত দেখে নয়, অফ দা পিচ দেখে খেলি। এজন্য দুসরা খেলতে আমার সমস্যা হয়। শ্রীলঙ্কায় সেবার মুরালিকে ভাল খেলতে পারিনি।

ওই সিরিজের সময়ই সেই সময়ের ভারত অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার দলে যদি মাশরাফির মতো একজন অলরাউন্ডার থাকত’

মাশরাফি:
মনে আছে। দ্রাবিড় বলেছিল, সৌরভ গাঙ্গুলিও বলেছিল। ভালো লাগে, ওসব মনে পড়লে। আবার খারাপও লাগে যে লম্বা সময় টেস্ট খেলতে পারিনি। ওই যে বললাম, যখনই ফর্মের চূড়ায় উঠেছি, তখনই আচমকা ইনজুরিতে ছিটকে পড়েছি।

২০০৩ সালের ইংল্যান্ড সিরিজটার কথাই ধরুন। ইংল্যান্ডের বড় বড় ব্যাটসম্যানরা আমাকে খেলতে হিমশিম খেয়েছে। ঢাকায় গ্রাহাম থর্পকে এমন একটা বাউন্সারে আউট করেছিলাম, ওই উইকেটে অমন গতির বাউন্সার সে ভাবতেই পারেনি। চট্টগ্রামে ২ বল খেলেই আমার বলে বোল্ড হয়েছিল থর্প। মার্ক বুচারও খেলতে পারেনি ঠিকমত।

আমার মনে আছে, একটা স্পেলে নাসের হুসেইন আমার বলে ব্যাটে লাগাতে পারেনি একবারও। চট্টগ্রামে ৪ উইকেট নিলাম, যার মধ্যে ছিল ভন-হুসেইন-থর্পের উইকেট। ওই টেস্টের সময়ই রাতে হোটেলে নাসের হুসেইনের সঙ্গে দেখা। ও বললো, ‘তুমি কাউন্টি খেলবে?’ আমি একটু ভাবলাম, কারণ বাড়ি ছেড়ে থাকতে ভাল লাগে না। তবু কাউন্টি বলে কথা, বললাম খেলব। হুসেইন আমার নম্বর নিয়ে রাখল, বলল ইংল্যান্ডে গিয়ে ফোন করবে। ভাগ্য দেখুন, পরদিনই ইনজুরিতে পড়লাম। ওই সময় আমি পরিণত হতে শুরু করেছি। একজন টেস্ট ফাস্ট বোলারের যে আগ্রাসন, যে গতি, নিয়ন্ত্রণ, সুইং দরকার, সব ছিল তখন আমার। ওই সময়টা ধরে রাখতে পারলে আমার টেস্ট ক্যারিয়ার অন্য উচ্চতায় থাকত। পারলাম না ইনজুরির কারণে।

পরে ২০০৬-২০০৭ সালেও খুব ভালো বোলিং করছিলেন…

মাশরাফি: ২০০৬ সালে ওয়ানডেতে সব দেশ মিলিয়েই সর্বোচ্চ উইকেট নিলাম। পরের বছর বিশ্বকাপ ও বিশ্বকাপের পরও ভালো করলাম। এরপরই ইনজুরি। ২০০৮-২০০৯ সালেও দারুণ বোলিং করছিলাম। সাকিব-তামিমরা তো ২০০৩ দেখেনি, ওরা এখনও বলে যে ‘মাশরাফি ভাই, ২০০৯ সালে আপনার সেরা বোলিং ছিল।’ আসলেই ওই সময় যা করতে চাইতাম, সব হতো। নেটে বা ম্যাচে মুখে বলে বলে দুই দিকে সুইং করাতাম বা ইয়র্কার মারতাম। চম্পকার (বাংলাদেশের সেই সময়ের বোলিং কোচ, সাবেক লঙ্কান পেসার চম্পকা রমানায়েকে) সঙ্গে অনেক কাজ করেছিলাম। পুরো নিয়্ন্ত্রণ চলে এসেছিল নিজের বোলিংয়ের ওপর।

দেশে ত্রিদেশীয় সিরিজ হলো। জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারা আমার বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। ফেরার সময় সাঙ্গা আমাকে বলেছিল, ‘সি ইউ সুন ইন ইন্ডিয়া।’ মানে আইপিএলে দেখতে চায়। সাঙ্গাই পরে যুবরাজ সিংকে বলেছিল আমাকে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবে নিতে। অকশনে প্রীতি জিনতা অনেক চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু জিতে নেয় জুহি চাওলা, কেকেআরে। যাই হোক, এত ভালো বোলিং করছিলাম তখন। অথচ ওই বছরই অধিনায়ক হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ইনজু্রি হলো। মনের ভেতর তাই ভয় কাজ করে। এখনও খুব ভালো বোলিং করতে থাকলেই আমার ভয় লাগে। আবার না জানি কোন ইনজুরি আসে!

৬ বছর হলো টেস্ট ক্রিকেট থেকে দূরে...বাংলাদেশের হয়ে আবার সাদা পোশাকে লাল বল হাতে দেখা যাবে মাশরাফিকে?

মাশরাফি: কতদিন খেলব আর জানি না। তবে যতদিনই খেলি, টেস্ট ক্রিকেট খেলার ইচ্ছে আমার আছে। জানি কাজটা কঠিন, কিন্তু ইচ্ছেটাও তীব্র। একটু যদি সময় পাই, একটু লম্বা সময় ধরে ইনজুরিমুক্ত থাকতে পারলে, হাঁটুর টুকটাক সমস্যাগুলো সারিয়ে উঠতে পারলে আমার বিশ্বাস টেস্ট ক্রিকেট আমি আবার খেলতে পারব। দিনে ১৫ ওভারের বেশি বোলিং তো হয়ত করতে হবে না। সেটা আমি এখনও পারব। তবে খুব ঝুঁকি হয়ে যাবে।

ব্যাপারটা কি এমন, যে অবসরের আগে একটা টেস্ট হলেও খেলতে চান?

মাশরাফি: নাহ। একটা খেলে অবসরে গেলাম, মনের শান্তি…ওভাবে ভাবি না আমি। ওটা তো স্বার্থপর ভাবনা হয়ে গেল। সেটা হলে এখনই বলে দিতাম। আমার ইচ্ছে আছে টেস্টে ফিরে কিছু সময় খেলে যাওয়ার। স্রেফ খেলার জন্য খেলা নয়। কিংবা হয়তো দল ভাবল, ‘ঠিক আছে, মাশরাফি চাইছে, ওকে টেস্ট খেলাই’…এভাবে নয়। যোগ্যতা-সামর্থ্য দিয়েই খেলতে চাই।