মুশফিক: স্টুয়ার্ট হবেন নাকি সাঙ্গাকারা?

দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম একই সঙ্গে টেস্ট দলের অধিনায়ক ও উইকেটরক্ষকও। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে এই মুহূর্তে তার বিকল্প দেখছেন না বিসিবি সভাপতি। মুশফিক নিজেও ছাড়তে চান না কিপিং। কিন্তু ওই দুটোর জাঁতাকলেই কি পিষ্ট মুশফিকের ব্যাটিং? প্রস্ফুটিত হচ্ছে না তার ব্যাটিং সামর্থ্যের পুরোটা?

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2015, 03:50 PM
Updated : 2 June 2015, 03:50 PM

শঙ্কা না সম্ভাবনা?

‘শাপে বর’ হওয়ার প্রেক্ষাপট প্রস্তুত। এখানে ‘শাপ’ মুশফিকের ডান হাতের অনামিকার চোট। পাকিস্তান সিরিজে পাওয়া চোট এখনও সঙ্গী বাংলাদেশ অধিনায়কের। ভারতের বিপক্ষে টেস্টে তাই উইকেট সামলাতে না পারার শঙ্কা আছে। এই শঙ্কাটাই আসলে একটা সম্ভাবনা। ‘শাপ’ হয়ে উঠতে পারে ‘বর’। হোক চোটের কারণে; তবু কিপার-ব্যাটসম্যান নয়, টেস্টে শুধু ব্যাটসম্যান মুশফিককে দেখতে পাওয়া যাবে।

শাপেবর না হওয়ার শঙ্কাটা থাকছে স্বয়ং মুশফিকের কারণেই। এই চোট তিনি পেয়েছেন গত পাকিস্তান সিরিজের প্রথম টেস্টে। দ্বিতীয় টেস্টের আগেও সেই চোট পুরোপুরি সারেননি। চাইলে মুশফিক অনায়াসেই দ্বিতীয় টেস্টে কিপিং গ্লাভস ছাড়তে পারতেন। স্কোয়াডে থাকা লিটন দাস প্রস্তুতই ছিলেন। কিন্তু মুশফিক ঝুঁকি নিয়েই দ্বিতীয় টেস্টে কিপিং করেছেন। কিন্তু চোটের কারণে শেষ পর্যন্ত সত্যিই যদি ভারতের বিপক্ষে ফতুল্লায় কিপিং করতে না পারেন; মুশফিকের জন্য সেটাই হতে পারে আশীর্বাদ!

তারা তিন জন

২০১০ সালে, এই জুন মাসেই ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আচমকা ঘোষণা দিলেন, টেস্টে আর উইকেটকিপিং করবেন না। বড় একটা ঝুঁকি। কারণ তখনও তিনি টেস্টে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান নন। তার তখনকার ব্যাটিং দিয়ে টেস্ট একাদশে জায়গা ধরে রাখা নিশ্চিত ছিল না। তবু ঝুঁকিটা তিনি নিয়েছিলেন। নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, টেস্টেও দলের মূল ব্যাটসম্যানদের একজন হয়ে উঠতে। জানতেন, সেই পথে বড় বাধা ছিল কিপিং। দীর্ঘ সময় কিপিং করে আবার টপ বা মিডল অর্ডারে নেমে নিয়মিত লম্বা ইনিংস খেলা প্রায় অসম্ভব। কিপিং ছাড়ার ঝুঁকিটা তাই নিয়েছিলেন। সেই চ্যালেঞ্জের ফল তো সবার জানাই।

কিপিং ছাড়ার পর প্রথম সিরিজেই করেছেন দ্বিশতক। পরে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে করেছেন ত্রিশতক। কিপিং ছাড়ার পর এই পাঁচ বছরে ওই ত্রিশতক ছাড়াও ডাবল সেঞ্চুরি তার তিনটি। আরেকটি আছে ১৯৫ রানের ইনিংস। অথচ কিপিং করে ব্যাটিং করে টেস্টে দেড়শ’ই ছুঁতে পেরেছেন মাত্র একবার (বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৮৫)। উইকেটরক্ষক হিসেবে ৫২ টেস্টে তার ব্যাটিং গড় ৩৪.১৮। কিপিং গ্লাভস না পরে খেলে ৪২ টেস্টে তার ব্যাটিং গড় ৪৩.৯০।

এবার আরেকজন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান এবং আরেক জুনের গল্প। সেটি ২০০৬ সালের জুন। কুমার সাঙ্গাকারা তখনই লঙ্কানদের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ। কিন্তু দৃষ্টি তার ছিল সুদূরে- শুধু নিজ দেশের সেরা নয়, ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরাদের একজন হওয়া। জানতেন, ব্যাট হাতে ইতিহাস গড়তে হলে ছাড়তে হবে কিপিংয়ের ভার। ২০০৬ সালের জুন মাসে সিদ্ধান্ত নিলেন কিপিং ছাড়ার। এর আগেও নানা সময়ে ১২টি টেস্টে কিপিং করেননি। ওই ১২ টেস্টে দুটি ডাবল সেঞ্চুরিও করেছেন। পাকাপাকি ভাবে কিপিং ছাড়ার পর প্রথম টেস্টেই ২৮৭ রানের ইনিংস, মাহেলা জয়াবর্ধনের সঙ্গে ৬২৪ রানের বিশ্বরেকর্ড জুটি। এরপর আর ভুলেও কিপিংয়ে ফেরার কথা ভাবেননি। ক্রমে ভালো ব্যাটসম্যান থেকে সাঙ্গাকারা হয়েছেন খুব ভালো ব্যাটসম্যান, আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। কিপিং করা ৪৮ টেস্টে ৭ শতকে সাঙ্গাকারার ব্যাটিং গড় ৪০.৪৮, কিপিং ছাড়া ৮২ টেস্টে ৩১ শতকে ব্যাটিং গড় ৬৯.৩৫! ১১ দ্বিশতকের ১০টিই শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলে।

উদাহরণ হিসেবে টানা যায় অ্যালেক স্টুয়ার্টকেও। কিপিং না করা ৫১ টেস্টে ব্যাটিং গড় ৪৬.৭০। দলের প্রয়োজনের খাতিরে ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে হয়েছে প্রতিভাবান এই ব্যাটসম্যানকে। কিপিং করা ওই ৮২ টেস্টে ব্যাটিং গড় নেমে এসেছে ৩৪.৯২-এ! ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড স্টুয়ার্টের (১৩৩টি)। তবু এখন প্রায়ই আফসোস করেন, কিপিং করতে না হলে ক্যারিয়ার গড়টা চল্লিশের নীচে না হয়ে হয়তো মধ্য চল্লিশে থাকতে পারত!

বাস্তবতার আয়নায়

উদাহরণগুলো হয়তো জানেন মুশফিক। চাইলে দেখতে পারেন ক্রিকেট ইতিহাসেও আরও অনেক উদাহরণ। চাইলে এসব কিছুও না দেখে ভাবতে পারেন শুধু বাস্তবতা। দলের সেরা ব্যাটসম্যানের কিপিং করা মানে স্রেফ আত্মঘাতী কাজ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দুর্বল বোলিং আক্রমণের দলে, যেখানে ফিল্ডিংয়ে প্রায়ই ১৫০ ওভারের আশেপাশে কিপিং করতে হয়। মূল ব্যাটসম্যানের কাছে দলের চাওয়া থাকে লম্বা সময় ব্যাটিং, বড় ইনিংস খেলা। কিন্তু ১৫০ ওভার কিপিং করার পর লম্বা ইনিংস খেলার সামর্থ্য আর কোথায় থাকে!

বাংলাদেশই একমাত্র দল, অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানকে যারা টেস্টে ব্যাটিংয়ে নামাচ্ছে ৬ নম্বরে। দীর্ঘ সময় কিপিংয়ের ক্লান্তিকে মাথায় রেখেই মুশফিকের ব্যাটিং অর্ডার এত নীচে। তাতে যেমন ক্ষতি হচ্ছে দলের, পুরো সম্ভাবনায় প্রস্ফুটিত হতে পারছে না মুশফিকের ব্যাটিং সামর্থ্যও।

তাছাড়া ৬ নম্বরে নামিয়েও অনেক সময় শেষ রক্ষা হয় না। সবশেষ টেস্টেই যেমন। পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে ১৫২ ওভার কিপিং করার পর আবার ২০ ওভারের মধ্যেই মুশফিককে নামতে হয়েছে ব্যাটিংয়ে। কারণ টপ অর্ডারের চার উইকেটে পড়েছে টপাটপ। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই চাপ নিতে পারেনি মুশফিকের শরীর। টেস্ট ক্যারিয়ারে মুশফিক বেশ কবার এমন অদ্ভুতুড়ে ও দৃষ্টিকটু শটে আউট হয়েছেন, যা তার মানের একজন ব্যাটসমানের জন্য খুবই বেমানান। স্কোরকার্ড বলছে, সেই দৃষ্টিকটু আউটগুলোর বেশিরভাগই ছিল লম্বা সময় কিপিং করে আবার দ্রুত ব্যাটিংয়ে নামার পর। সেটাই স্বাভাবিক।

এটা ঠিক যে, কিপিং করেই টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম দ্বিশতক করেছিলেন মুশফিক। কিন্তু কিপিং করায় ক্লান্তির কারণে বড় করতে পারেননি অনেক সম্ভাবনাময় ইনিংসও! কেন টেস্টে নিয়মিত খেলতে পারছেন না লম্বা ইনিংস? তার মতো টেকনিক ও টেম্পারমেন্টের একজন ব্যাটসম্যানের পাশে ৪৫ টেস্টে ৩ সেঞ্চুরি আর ৩২ গড় বড্ড বেমানান; তার ব্যাটিং সামর্থের প্রতি চরম অবিচারও। মুশফিক কি তবে বঞ্চিত করছেন নিজেকে, দলকে, দেশকে।

এবং নেতৃত্ব

এত কথা শুধু কিপিং ভার নিয়েই। মুশফিকের কাধে আরেকটি বড় ভার তো আছেই। দলের মূল ব্যাটসম্যান ও উইকেটকিপিংয়ের পাশাপাশি অধিনায়কও তিনি। ক্রিকেট ইতিহাস বলে, এই তিন ভুমিকায় এক সঙ্গে থেকে সফলতার কোনো নজির নেই। টেস্টে কিপিংয়ে এতটাই একনিষ্ট থাকতে হয়, এতটাই পরিশ্রম, মনোযোগ দাবি করে যে, একদমই বিকল্প না থাকলে সাধারণত উইকেটকিপারকে অধিনায়ক করা হয় না। ১৩৮ বছরের টেস্ট ইতিহাস তাই দেখেছে মাত্র ২৯ জন কিপার-অধিনায়ক। যাদের ১০ জনই আবার নেতৃত্ব দিয়েছেন একটি, দু’টি বা তিনটি টেস্টে; মানে চালিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব বা ঠেকার কাজ। ২০টির বেশি টেস্টে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন কেবল ভারতের মহেন্দ্র সিং ধোনি (৬০টি) ও মুশফিক (২১)।

ধোনি এতগুলো টেস্টে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন দলের মূল ব্যাটসম্যানদের একজন ছিলেন না বলেই। তারপরও টেস্টে ধোনির নেতৃত্বগুন প্রশ্নবিদ্ধ। রঙিন পোশাকের সফল অধিনায়ক ধোনি টেস্টে ছিলেন ভীষণরকম নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ, সৃষ্টিশীলতাহীন, নেতিবাচক মানসিকতার অধিনায়ক। টেস্ট ক্যারিয়ার জুড়েই ধোনির নেতৃত্ব ছিল সমালোচিত।

দলের মূল ব্যাটসম্যানদের একজন হয়েও টেস্টে নেতৃত্ব দেওয়া ও কিপিং করা-এই তিন ভুমিকায় মুশফিক ছাড়া টেস্ট ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় আর মাত্র দুজনকে- অ্যালেক স্টুয়ার্ট ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। ফ্লাওয়ার এই তিন দায়িত্বে থাকতে পেরেছিলেন ১৬টি টেস্টে, স্টুয়ার্ট ১২টি টেস্টে। মুশফিকের সেখানে ক্ষান্তি দেওয়ার ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে না। বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান সম্প্রতি বলেছেন, যথেষ্ট বিকল্প নেই বলে মুশফিকই আপাতত থাকছেন টেস্ট অধিনায়ক। সেক্ষেত্রে একটি ছাড়তে হলে মুশফিককে ছাড়তে হবে কিপিংই। বোর্ড প্রধান, টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচকেরাও যে এটি চান, সেটি গত কদিনে তাদের কথাবার্তায়ও ফুটে উঠেছে বেশ কবার। কিন্তু তারা মুশফিককে একটুও চাপ দিতে চান না। চাপ দেওয়া উচিতও নয়। এগিয়ে আসতে হলে আসতে হবে মুশফিকের নিজেরই। স্বার্থপর ভাবনা থেকে হলেও অন্তত বোঝা উচিত নিজের ভালোটা!

ভবিষ্যতের আয়না

কোনো সন্দেহ নেই, ক্যারিয়ার জুড়ে এই তিন ভুমিকা চালিয়ে গেলেও দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান থাকবেন মুশফিক। সেই প্রতিভা, সামর্থ্য, ইচ্ছাশক্তি তার আছে। হয়ত একদিন দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলবেন, সবচেয়ে বেশি রান করবেন। কিন্তু তার তো সামর্থ্য আছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়ার! শুধু দেশের সেরা নয়, বিশ্বসেরাদের একজন হওয়া। ‘ভালো’ আর ‘খুব ভালো’ সীমা ছাড়িয়ে ‘গ্রেট’ হয়ে ওঠার। সামর্থ্য আছে ক্রিকেট ইতিহাসে নিজের আলাদা একটা জায়গা করার। সামর্থ্য আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একজন সত্যিকারের কিংবদন্তি উপহার দেওয়ার। কিন্তু কিপিং না ছাড়লে ব্যাটিংয়ে ওই উচ্চতায় ওঠো সম্ভব নয়। অ্যালেক স্টুয়ার্টের মতো ক্যারিয়ার শেষে হয়ত ঝরবে আক্ষেপ।

এখন মুশফিককেই ঠিক করতে হবে তিনি দেশসেরা হয়েই তৃপ্ত থাকবেন; নাকি উঠতে চাইবেন বিশ্বসেরাদের উচ্চতায়। তাকেই ঠিক করতে হবে তিনি অ্যালেক স্টুয়ার্ট হবেন নাকি কুমার সাঙ্গাকারা।