অস্ট্রেলিয়ায় উজ্জ্বল বাংলাদেশ: আমিনুল

পরিবার নিয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থিতু বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ক্রিকেট ভিক্টোরিয়ায় কাজ করছেন কোচ হিসেবে; এসিসির ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন প্রায় আট বছর ধরে। পারিবারিক প্রয়োজনে ঢাকায় এসে সোমবারে পা রেখেছিলেন মিরপুরে শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। সেখানেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমিনুল বললেন বিশ্বকাপ ও পাকিস্তান সিরিজের পারফরম্যান্সে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের বদলে যাওয়া ভাবমূর্তি, ভারত সিরিজের প্রত্যাশা, এসিসি বন্ধ করে দেওয়া এবং কোচ হিসেবে তার ভবিষ্যত নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2015, 05:12 PM
Updated : 2 June 2015, 09:48 AM

অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট মহলে এখন কোন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে?

আমিনুল ইসলাম: আগে বলে নেই, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরিচিতির প্রথম যোগসূত্রটা ছিলাম কিন্তু আমিই। প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৮৮ সালে। তখন বাংলাদেশ খেলার সুযোগ পায়নি। তবে আইসিসি সহযোগী দেশগুলোর একটি সম্মিলিত দল খেলান হয়েছিল, যেটিতে বাংলাদেশ থেকে সুযোগ পেয়েছিলাম আমি আর লিটন (হারুনুর রশিদ)। সত্যি বলতে সেই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট মহল জানতে পারল যে বাংলাদেশে সিরিয়াস ক্রিকেট খেলা হয়। খেলা ছাড়ার পর আমি ২০০৪ সালে এক দফায় গিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া। পরে দেশে কোচিং করিয়েছি, মালয়েশিয়ায় কাজ করার পর বছর দেড়েক হলো থাকছি অস্ট্রেলিয়ায়। দেড় বছর আগের কথা বললেও এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ধারণা অনেক উজ্জ্বল ওদের।

সেটা কেমন? মানে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সই তো সব বদলে দিয়েছে

আমিনুল: এমনিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ধারণা তো ওদের ছিলই। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া সফরেও গিয়েছে দুবার। যদিও মূল ভেন্যুগুলোতে খেলার সুযোগ হয়নি, নর্দান অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে হয়েছে। তবে বাংলাদেশকে নিয়ে ধ্যান-ধারণায় বিশাল পরিবর্তন হয়েছে বিশ্বকাপ থেকে। অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে বাংলাদেশ এখন দুর্বল বা পায়ের নিচে মাটি খুঁজতে থাকা দল নয়, শক্তিশালী একটি দল। যারা লড়াই করতে জানে। অস্ট্রেলিয়ানরা লড়াই ব্যাপারটিকে খুব শ্রদ্ধা করে। বাংলাদেশ সেদিক থেকে অস্ট্রেলিয়ানদের শ্রদ্ধা কুড়িয়ে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ানরা এখন জানে, দলটাই যে শুধু শক্তিশালী নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি এখন উন্নত হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়াতে পেশাদার কোচ হিসেবে কাজ করছেন। বাংলাদেশের অমন পারফরম্যান্সের পর আপনার প্রতি শ্রদ্ধাও নিশ্চয়ই বেড়েছে!

আমিনুল: আমি ক্রিকেট ভিক্টোরিয়ায় কাজ করছি। বিশ্বকাপের আগে আমার গ্রহণযোগ্যতা যেমন ছিল, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের পর সেটি ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পাল্টে গেছে। অনেক বেশি শ্রদ্ধার সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে আমাকে। একটা বাচ্চা ছেলে বা কিশোর ক্রিকেটারকে যখন কিছু শেখাচ্ছি, আমার ওপর তার বিশ্বাসটা আগের চেয়ে অনেক বেশি এখন। সেটি বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের কারণেই।

আরেকটা উদাহরণ দিতে পারি। ক্রিকেট ভিক্টোরিয়ার একটি বিশেষ সেল আছে, যেখানে ক্রিকেটের বিভিন্ন দিক থেকে আলাদা করে কাজ করা হয়। একটি আছে যেমন, ‘হাউ টু প্লে স্পিন বোলিং’, আগে সেখানে আমার ডাক বেশি পড়ত না। থিলান সামারাবিরা (সাবেক লঙ্কান ক্রিকেটার) মূলত কাজ করত। বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর থেকে এখন সেখানে তারা আমাকে নিয়মিত ডাকে।

পাকিস্তান সিরিজে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স কেমন আলোচিত হয়েছে ওখানকার ক্রিকেট মহলে?

আমিনুল: পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার পর কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেট আরও উচ্চতায় উঠে গেছে। অস্ট্রেলিয়ানরা পাকিস্তানের ক্রিকেটকে খুব শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে সেই ইমরান খানের সময় থেকেই। পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়াতে বিশ্বকাপ জিতেছে, দারুণ সব ফাস্ট ও স্পিন বোলার উপহার দিয়েছে ক্রিকেটকে, এই কারণে। তো সেই পাকিস্তানকে উড়িয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে ধারণা আরও উজ্জ্বল হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। সবাই বুঝতে পেরেছে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সটা ফ্লুক নয়।

বিশ্বকাপের আগে তো আপনি একটি কোচিং সেমিনারও করিয়েছিলেন ওখানে?

আমিনুল: বিশ্বকাপের আগে ক্রিকেট ভিক্টোরিয়া একটি কোচিং সেমিনার আয়োজন করেছিল লেভেল টু ও আর্লি লেভেল থ্রি কোচদের জন্য। ওখানে মাইকেল বেভান, ডেমিয়েন ফ্লেমিং, থিলান সামারাবিরার সঙ্গে আমাকেও ডাকা হয়েছিল ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে। ওখানে আমি বলেছিলাম, অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ন হবে, বাংলাদেশ কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলবে। সেটাই হয়েছে! আমার ভাল লেগেছিল আরেকটা ব্যাপার। ভেবেছিলাম, বাংলাদেশের একজন কোচ হিসেবে আমাকে হয়ত বেভান বা ফ্লেমিংদের মত অত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে না। কিন্তু আমার কাছে অনেক অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল, অনেক কিছু জানতে চেয়েছিল। খুব ভালো লেগেছে।

বিশ্ব ক্রিকেটে উঠতি কোচদের মধ্যে বেভান বা ফ্লেমিংদের তো দারুণ সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের সঙ্গে লেকচার দিতে পারার অনুভুতি কেমন ছিল?

আমিনুল: আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। আমি এসিসিকে (এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল) ধন্যবাদ জানাই। ৮ বছর ধরে আমি এসিসিতে কাজ করছি। অনেক শিখেছি, শিখছি। অনেক জায়গায় কোচিং করিয়েছি, অনেক খুঁটিনাটি জেনেছি, দেখেছি। এ ধরনের সেমিনার বা বড় বড় কোচদের সঙ্গে কাজ করতে তাই খুব আত্মবিশ্বাসী থাকি। বাংলাদেশের একজন হিসেবেও খুব গর্ব হয়। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান, প্রথম বিশ্বকাপ অধিনায়ক হিসেবে যখন পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় সব জায়গায়, গর্বের জায়গাটা আরও বেড়ে যায়।

এসিসির প্রসঙ্গ যখন টানলেন, এটিই তো এসিসির শেষ মাস। এটিই আর থাকছে না, আপনাদের কাজের ধরন কেমন হবে?

আমিনুল: দেখুন, এসিসি মূলত ছিল আইসিসির রিজিওনাল বডি। এসিসির সুবিধা ছিল এশিয়া কাপের আয় দিয়ে সংস্থাটি বিভিন্ন আঞ্চলিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করত। আইসিসির ডেভোলপমেন্ট ফান্ডের ৫০ ভাগই নিয়ে নিত এসিসি, কারণ এই অঞ্চল থেকে আইসিসির আয়টা ছিল বেশি। এখন এসিসি বন্ধ হওয়ার সিদ্ধান্তের পর আমাদের চাকরির চেয়েও বেশি ভাবনা ছিল এশিয়ার ডেভোলপমেন্ট নিয়ে। চীন, তাইওয়ানের মতো দেশগুলো আমাদের সন্তানের মত। এই দেশগুলোতে ক্রিকেটের পরিচয় হয়েছে আমাদের মাধ্যমে, ক্রিকেটার-কোচদের আমরা গড়ে তুলেছি। তবে আশার কথা, ডেভোলপমেন্ট প্রোগ্রামগুলো বন্ধ হবে না। একই কাজ আইসিসির মাধ্যমে করা হবে। এসিসির চারজন ডেভেলপমেন্ট অফিসারই আমরা থাকছি। এখন আইসিসির ডেভেলপমেন্ট অফিসার বা গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করব। আগে রিপোর্টিং অফিস ছিল কুয়ালালামপুর, এখন হবে দুবাই।

কিন্তু এতে এশিয়ার ক্রিকেটের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হতে পারে না?

আমিনুল: বাধাগ্রস্ত তো হবেই। এশিয়ার দেশগুলো তো ফিজি বা পাপুয়া নিউগিনির মত নয় বা উত্তর আমেরিকা বা আফ্রিকার মত নয়। এখানের ক্রিকেটের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জনপ্রিয়তা আছে। এখন ওই দেশগুলোর সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলে আইসিসি ভালো করে বুঝলেই হলো। একটা শঙ্কার জায়গা থেকেই যাচ্ছে।

এই মুহুর্তে আপনার মূল কাজ কি?

আমিনুল: আমার মূল দায়িত্ব হংকংকে প্রস্তুত করা। সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং খেলতে যাচ্ছে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ তো খেলছেই। এরপরের দল আমার সিঙ্গাপুর ও কুয়েত। এরপরে একবারে নতুন দল, যেটা ছিল স্পেশাল প্রজেক্ট, চীন ও তাইওয়ান। এই দেশগুলোতে ক্রিকেট উন্নয়ন থেকে শুরু করে কোচদের কোচিং করানোর কাজ আমি করি।

কদিন পরই ভারতের বিপক্ষে সিরিজ। বাংলাদেশ দলের কাছে প্রত্যাশা কি?

আমিনুল: টেস্ট আমাদের ড্র করা উচিত অন্তত। আমি বলছি না যে আমাদের ড্রয়ের জন্য খেলতে হবে বা খেলা উচিত। মাঠে নামা উচিত জিততেই। তবে ড্র করাটা খুব খারাপ হবে না। শুধু ফল নয়, মাঠের পারফরম্যান্সেও পাকিস্তানের বিপক্ষে আগের সিরিজের চেয়ে উন্নতির প্রমাণটা যেন রাখতে পারি। ওয়ানডেতে আমরা এখন অনেক পরিণত দল। আমার তো মনে হয়, দলের সবার ওয়ানডে ম্যাচ যোগ করলে ভারতের চেয়ে আমাদের দলের অভিজ্ঞতা বেশি হবে। ওয়ানডে সিরিজ তাই আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত। র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্যও সিরিজটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের টার্গেট করা উচিত ৬ নম্বর, যাতে অন্তত সাতে উঠতে পারি আমরা।