বিশ্বকাপের ১০ ফাইনাল

শেষ হতে চলেছে বিশ্বকাপের একাদশ আসর। শিরোপা লড়াই কেবল বাকি। মেলবোর্নের ফাইনালের আগে গত ১০ আসরের ফাইনালগুলো একটু দেখে নেয়া যাক।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2015, 01:56 PM
Updated : 27 March 2015, 05:19 PM

রোববার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড বা এমসিজিতে শিরোপা লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে এবারের আসরের দুই সহ-আয়োজক অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ড।  

প্রথম ফাইনাল: লর্ডস, লন্ডন ২১ জুন, ১৯৭৫

অস্ট্রেলিয়াকে ১৭ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম আসরের শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ম্যাচ সেরা ক্লাইভ লয়েডের অসাধারণ শতকে ৬০ ওভারে আট উইকেটে ২৯১ রান তোলে ক্যারিবিয়ানরা। ডেনিস লিলি, জেফ টমসনদের মতো পেসারদের বিপক্ষে ৮৫ বলে ১০২ রানের চমৎকার ইনিংস খেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক।

জবাবে কিথ বয়েসদের (৪/৫০) দারুণ বোলিংয়ে অলআউট ২৭৪ রানে অলআউট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।

অস্ট্রেলিয়ার হারে সবচেয়ে বড় দায় তাদের পাঁচ ব্যাটসম্যানের রান আউটে, যার তিনটি হয় ভিভ রিচার্ডসের থ্রোতে।

দ্বিতীয় ফাইনাল: লর্ডস, লন্ডন ২৩ জুন, ১৯৭৯

 

স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ৯২ রানে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। 

‘কিং’ রিচার্ডস ইনিংসের শেষ বলে হেঁটে গিয়ে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলকে ফ্লিক করে যে ছক্কা মারেন, সেটি হয়ে আছে ক্রিকেট রূপকথার চিরন্তন অংশ। রিচার্ডস (অপরাজিত ১৩৮) ও কলিন্স কিংয়ের (৮৬) দারুণ ব্যাটিংয়ে ৬০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৮৬ রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

জবাব দিতে নেমে ইংল্যান্ড উদ্বোধনী জুটিতে তুলে ফেলে ১২৯ রান। ৩৯তম ওভারে সেই জুটি ভাঙার পর এক সময়ে দুই উইকেট ১৮৩ রানে পৌঁছেছিল তারা। সেখান থেকে রানের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে ১১ রানে যায় শেষ আট উইকেট।

ইংল্যান্ডকে ১৯৪ রানে অলআউট করায় দারুণ অবদান ৩৮ রানে পাঁচ উইকেট নেয়া ‘বিগ বার্ড’ জোয়েল গার্নারের। তবে অসাধারণ অপরাজিত সেঞ্চুরির জন্য নায়কের আসনটা যে বরাদ্দ হয়ে ছিল রিচার্ডসের জন্যই।

তৃতীয় ফাইনাল: লর্ডস, লন্ডন ২৫ জুন, ১৯৮৩

 

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪৩ রানে হারিয়ে অঘটনের বিশ্বকাপে শিরোপা জেতে ভারত।

অ্যান্ডি রবার্টস, গার্নার, ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংয়ের পেস ব্যাটারির সামনে ১৮৩ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের টানা তৃতীয় শিরোপা জয় যখন সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল তখন ভারতের অধিনায়ক কপিল দেব দিলেন সেই অমর ক্রিকেটীয় বাণী, “ছেলেরা, আমাদের স্কোর যদি ম্যাচ জেতার মতো না-ও হয়, লড়াই করার মতো তো বটেই। এসো আমরা সেই লড়াইটাই করি।”

সেই লড়াইয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন কপিল। মিড উইকেটে প্রায় ২০ গজ পেছন দিকে দৌড়ে বিপজ্জনক রিচার্ডসের দারুণ এক ক্যাচ তালুবন্দি করেন তিনি। ম্যাচের মোড় তাতেই যায় ঘুরে।

মদনলাল-মহিন্দার অমরনাথদের মতো মিডিয়াম পেস বোলারদের সামনে আত্মাহুতির মিছিলে সামিল হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কালজয়ী ব্যাটিং লাইন; মাত্র ১৪০ রানে অলআউট তারা। ব্যাটিংয়ে ২৬ রান করা অমরনাথ বোলিংয়ে সাত ওভারে ১২ রান দিয়ে নেন তিন উইকেট।

চতুর্থ ফাইনাল: ইডেন গার্ডেনস, কলকাতা ৮ নভেম্বর, ১৯৮৭

 

রোমাঞ্চকর ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডকে ৭ রানে হারিয়ে চার শিরোপার প্রথমটি জেতে অস্ট্রেলিয়া। 

আগে ব্যাট করে পাঁচ উইকেটে ২৫৩ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচ সেরা ডেভিড বুনের ৭৫ রান যে ইনিংসের ভিত্তি। আর শেষ দিকে মাইক ভেলেটার ৩১ বলে অপরাজিত ৪৫ রানে আড়াইশ’ পার হয় তারা।

জবাবে বিল অ্যাথি (৫৮) আর মাইক গ্যাটিং (৪১) ইংল্যান্ডকে জয়ের পথেই রেখেছিলেন। দুই উইকেটে ১৩৫ রান- এমন সময় অ্যালান বোর্ডারকে অহেতুক রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ দেন গ্যাটিং। যে মুহূর্তটি বিবেচিত আগের আসরের ফাইনালে কপিলের নেওয়া রিচার্ডসের ক্যাচের মতোই টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে।

গ্যাটিংয়ের আউটে ধাক্কা খাওয়া ইংল্যান্ডের ইনিংস থেমে যায় ৮ উইকেটে ২৪৬ রানে।

পঞ্চম ফাইনাল: এমসিজি, মেলবোর্ন ২৫ মার্চ, ১৯৯২

 

তৃতীয় ফাইনালে খেলা ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে শিরোপা জেতে পাকিস্তান।

২৪ রানের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে শুরুটা ভালো হয়নি পাকিস্তানের। এরপর দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ইমরান খান (৭২) ও জাভেদ মিয়াঁদাদ (৫৮) তাদের ইনিংসকে স্থিতি দেন। শেষ দিকে ইনজামাম উল হক (৩৫ বলে ৪২) ও ওয়াসিম আকরামের (১৮ বলে ৩৩) ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ছয় উইকেটে ২৪৯ রানে ইনিংস শেষ করে পাকিস্তান।

জবাব দিতে নেমে ইংল্যান্ডের শুরুটাও ছিল এলোমেলো। স্কোরবোর্ডে ৬৯ রান তুলতেই চার উইকেট হারিয়ে বসে তারা। অ্যালান ল্যাম্ব ও নেইল ফেয়ারব্রাদারের ৭১ রানের জুটি তাদের কক্ষপথে ফেরায়। তবে শেষরক্ষা হয়নি তাদের, ম্যাচ সেরা আকরামের দারুণ বোলিংয়ে ২২৭ রানে অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড।  

টুর্নামেন্টের প্রথম পাঁচ ম্যাচে এক জয় পেয়েছিল যে পাকিস্তান, তারাই কিনা শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন! ক্রিকেটীয়-রূপকথা আর কাকে বলে! গ্রুপ পর্বে এই পাকিস্তানই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হয়েছিল।

ষষ্ঠ ফাইনাল: গাদ্দফি স্টেডিয়াম, লাহোর ১৭ মার্চ, ১৯৯৬

 

সাবেক চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জেতে শ্রীলঙ্কা। এই প্রথম কোনো দল বিশ্বকাপের ফাইনালে লক্ষ্য তাড়া করে জেতে।

আগে ব্যাট করে সাত উইকেটে অস্ট্রেলিয়া করে ২৪১ রান, যে ইনিংসের জ্বালানি ছিল অধিনায়ক মার্ক টেলরের ৭৪ রান।

৯ ওভার অফস্পিন করে ডি সিলভা ৪২ রানে নেন তিন উইকেট। দারুণ দুটি ক্যাচও ধরেছিলেন তিনি। তবে সেসব এখন আর মনে রেখেছে কে! ম্যাচ সেরা ডি সিলভার ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের স্মৃতিটাই যে জ্বলজ্বলে সবার মনে।

লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২৩ রানের মধ্যে সনাৎ জয়সুরিয়া- রুমেশ কালুভিথারানাকে হারায় শ্রীলঙ্কা। অশঙ্কা গুরুসিংহকে নিয়ে এরপর ১২৫ রানের জুটি গড়ে ম্যাচের ভাগ্য লিখে দেন ডি সিলভা। এরপর অধিনায়ক রানাতুঙ্গার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ৯৭ রানের জুটিতে শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপ জেতান তিনি। অধিনায়ক যখন জয়সূচক রান নেন, ডি সিলভা তখন অপরাজিত ১০৭ রানে।

সপ্তম ফাইনাল: লর্ডস, লন্ডন ২০ জুন, ১৯৯৯

 

সাবেক চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে ৮ উইকেটে হারিয়ে টানা তিন শিরোপার প্রথমটি জয় করে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপের সফলতম দলটির এটি ছিল দ্বিতীয় শিরোপা।  

৩৯.১ ওভার ব্যাটিং করে মাত্র ১৩২ রানে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। তাদের ইনিংসের সর্বোচ্চ ছিল মাত্র ২২ রান, এসেছিল ইজাজ আহমেদের ব্যাট থেকে।

অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ ট্র্রফিস্পর্শ নিশ্চিত করে মোটে ২০.১ ওভার ব্যাটিং করে, মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে। ঝড়ো অর্ধশতক করে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (৩৬ বলে ৫৪)।

সেমি-ফাইনালের মতো ফাইনালেও চার উইকেট নেন শেন ওয়ার্ন। দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন এই লেগ স্পিন জাদুকর।

অষ্টম ফাইনাল: নিউ ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম, জোহানেসবার্গ ২৩ মার্চ, ২০০৩

 

সাবেক চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ১২৫ রানে হারিয়ে টানা তিন শিরোপার দ্বিতীয়টি জেতে অস্ট্রেলিয়া। প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপে তিনটি শিরোপা জেতে তারা।

টস হেরে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং বিস্ফোরক শতকে এক অর্থে এক অর্ধেই খেলা শেষ করে দেন। গিলক্রিস্ট-ম্যাথু হেইডেন মাত্র ১৪ ওভারে ১০৫ রানের উদ্বোধনী জুটিতে গড়ে দেন ভিত্তি। এরপর পন্টিং ১২১ বলে ১৪০ রানের অসাধারণ ইনিংস খেললে দুই উইকেটে ৩৫৯ রানের পাহাড় গড়ে অস্ট্রেলিয়া।

সেটি টপকানোর সাধ্য ভারতের ছিল না। প্রথম ওভারেই শচিন টেন্ডুলকার আউট হয়ে যাওয়ায় সেটি হয়ে পড়ে আরো অসম্ভব। বিরেন্দর শেবাগ (৮২) চেষ্টা করেছিলেন কিছুটা। তবু জয়ের ধারেকাছেও যেতে পারেনি ভারত। ৩৯.১ ওভারে ২৩৪ রানে অলআউট হয়ে তারা।

নবম ফাইনাল: কেনসিংটন ওভাল, ব্রিজটাউন ২৮ এপ্রিল, ২০০৭

 

শ্রীলঙ্কাকে ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে ৫৩ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপে টানা তৃতীয় ও সব মিলিয়ে চতুর্থ শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া।   

ওয়ানডের সেরা টুর্নামেন্টে এই প্রথম কোনো ফাইনাল হল ‘রি-ম্যাচ’। শ্রীলঙ্কার সামনে সুযোগ ছিল ১৯৯৬ সালের পুনরাবৃত্তির। কিন্তু সেটি ছাপিয়ে প্রতিশোধই হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার।

বৃষ্টির কারণে ৩৮ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে চার উইকেটে ২৮১ রান করে অস্ট্রেলিয়া। এতে সবচেয়ে বড় অবদান ১০৪ বলে ১৪৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলা গিলক্রিস্টের।

দ্বিতীয় উইকেটে জয়াসুরিয়া ও কুমার সাঙ্গাকারা ১১৬ রানের জুটিতে ভালোই জবাব দিচ্ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই দুজনের বিদায়ের পর আর পেরে উঠেনি শ্রীলঙ্কা।

মাঝখানে আবার বৃষ্টি নামলে শ্রীলঙ্কার নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৬ ওভারে ২৬৯ রান। তার ধারে কাছেও যেতে না পারা শ্রীলঙ্কার ইনিংস থেমে যায় ৮ উইকেটে ২১৫ রানে।

দশম ফাইনাল: ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম, মুম্বাই ২ এপ্রিল, ২০১১

 

টানা দ্বিতীয় ফাইনালে খেলা শ্রীলঙ্কাকে ৬ উইকেটে হারিয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় শিরোপা জেতে ভারত।

আগে ব্যাট করে মাহেলা জয়াবর্ধনের (১০৩) অপরাজিত শতকে ছয় উইকেটে ২৭৪ রান তোলে শ্রীলঙ্কা।

এরপর লাসিথ মালিঙ্গা টেন্ডুলকার-শেবাগকে দ্রুত ফিরিয়ে দিলে ম্যাচের পাল্লা কিছুটা হলেও হেলে লঙ্কানদের দিকে। কিন্তু গৌতম গম্ভির, বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ফেরান আবার ভারতের দিকে।

লং অনের উপর দিয়ে ছক্কা মেরে ধোনি যখন ভারতের ছয় উইকেটের জয় নিশ্চিত করে, ডাগআউটে তখন চিকচিকে আনন্দাশ্রু একজনের চোখের কোণে-১৯৮৩ আসরের সেই বালকের; শচিন টেন্ডুলকারের।