মিয়াঁদাদের কলাম: পাকিস্তানের কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা

ভারতের বিপক্ষে হারের পর বিস্তর অভিযোগ ছিল জাভেদ মিয়াঁদাদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে আরও বড় হারে তালিকাটা বড় হয়েছে। সরফরাজ আহমেদকে একাদশে না নেওয়া, ফর্মহীন ইউনিস খানের উপর আস্থা, থিঙ্ক ট্যাঙ্কের পরিকল্পনাহীনতা, ফিল্ডিংয়ের ব্যর্থতা-অভিযোগের শেষ নেই পাকিস্তানের এই কিংবদন্তির। তাই বলে দুই হারে দলটির বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হয়ে গেছে বলেও মানছেন না তিনি।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2015, 07:17 PM
Updated : 22 Feb 2015, 05:03 PM

ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে পাকিস্তানের দেড়শ’ রানের হারটাকে শুধু ‘বিশৃঙ্খল’ বললে কম হয়ে যায়। চলতি বিশ্বকাপে পাকিস্তান থিঙ্ক ট্যাঙ্কের পরিকল্পনা দেখে সত্যি কষ্ট হচ্ছে খুব। পাকিস্তানকে মনে হচ্ছে ফাটল ধরা এক দল, যাদের ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে ক্রমশ। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে হারের আঁচড়টা শুকাতে পারেনি; এরই মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওই কাটা ঘায়ে দিল নুনের ছিটা।

মনে হচ্ছে, মিসবাহ-উল-হক খুব দ্রুত আস্থা হারিয়ে ফেলছে বোলারদের ওপর। ব্যাটসম্যানরাও বেরিয়ে আসতে পারছে না বাজে ফর্ম থেকে। ওয়ানডে ক্রিকেটটা খেলতে হয় নিজ দলের শক্তির বিবেচনায়। তা মিসবাহ যদি আট ব্যাটসম্যান নিয়ে একাদশ সাজায়, তাহলে টস জিতে আগে বোলিং করার যৌক্তিকতা কোথায়?

এই পাকিস্তানের বোলিংয়ে নেই ওয়াসিম আকরাম অথবা ওয়াকার ইউনিস মানের কেউ। আর এই গড়পড়তা বোলিং বিভাগ যদি ফিল্ডারদের যথার্থ সহায়তা না পায়, তাহলে প্রতিপক্ষের তিনশ’ রান তোলাটা অবধারিত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হয়েছে ঠিক তাই। চার-চারটি ক্যাচ পড়েছে পাকিস্তানি ফিল্ডারদের মুঠো গলে, যার প্রত্যেকটাই ছিল ধরার মতো। শহীদ আফ্রিদির মতো দারুণ ফিল্ডার পর্যন্ত ফেলেছে দুই ক্যাচ। নাসির জামশেদ, মোহাম্মদ ইরফানরাও হারিয়েছে ক্যাচ নেওয়ার মতো সুযোগ।

গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রস্তুতি ছিল অনেক ভালো। নিজেদের প্রথম ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের কাছে হারে তারা। পাকিস্তানের বিপক্ষে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে খেলতে নামে তাই। ব্যাটিং ইনিংসের ৪০তম ওভার পর্যন্ত তেমন কোনো বড় শট বলতে গেলে খেলেইনি। এরপর শেষ ৬০ বলে পাকিস্তানের অনভিজ্ঞ বোলিং লাইনের উপর দিয়ে বইয়ে দিয়েছে ঝড়।

‘স্লো ডেলিভারি’ বোলিংয়ের এমন এক শিল্প, একমাত্র অভিজ্ঞ বোলাররাই যেটির ব্যবহার করতে পারে যথাযথ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আন্দ্রে রাসেলের বিপক্ষে সোহেল খান ও ওয়াহাব রিয়াজ সেই চেষ্টা করেছে বড্ড বেশি। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বলের ঠিকানা হয়েছে মাঠের নানা প্রান্তের গ্যালারিতে। পাকিস্তানের সমস্যা হচ্ছে, আস্থা রাখা যায় এমন মোটে তিনজন বোলার খেলিয়েছে তারা। এর মধ্যে শহীদ আফ্রিদি আবার অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের উইকেট থেকে সহায়তা পাচ্ছে না তেমন। ভালো দলগুলো এই লেগ স্পিনারকে উইকেট দেবে না কখনোই। তারা জানে, পাকিস্তানের বোলিং লাইনে দুর্বলতা কম নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজও জানত, আফ্রিদির ১০ ওভার পার করে দিতে পারলে তাদের ব্যাটিং লাইনে এমনসব বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান রয়েছে, যারা পাকিস্তানের বাদবাকি ক্লাব-পর্যায়ের বোলারদের মেরে তুলোধুনো করতে পারবে। তাদের সেই জানায় ভুল কিছু ছিল না।

বিশ্বকাপের জন্য যে ১৫ সদস্যের স্কোয়াড দিয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচকরা, আমি এর সঙ্গে একমত নই। এখন তো মনে হচ্ছে, সফরের নির্বাচক কমিটি একাদশ নির্বাচন নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশায়। পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীরা সরফরাজ আহমেদের একাদশে না থাকাটা মানতে পারছেন না। ইউনিস খানের বিবর্ণ ফর্মও ক্রিস্টালের মতো স্পষ্ট। বেশি দেরি হওয়ার আগে এই দুটো ‘সমস্যা’ মিসবাহকে দ্রুত সম্ভব সমাধান করতে হবে।

ক্রাইস্টচার্চের উইকেটে এমন কোনো ‘গোখরার ছোবল’ ছিল না, যাতে ভয় পেতে পারে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা। জেরম টেইলর অফ স্ট্যাম্পের ঠিক বাইরে বাইরে বল করে প্রতিপক্ষের দুর্বলতাই কাজে লাগিয়েছে কেবল। এই পেসার পাকিস্তানি টপ অর্ডার গুড়িয়ে স্কোরকে যখন এক রানে চার উইকেটে পরিণত করে, ম্যাচ তখনই শেষ!

মিসবাহকে মনে হল, ফর্মের জন্য ধুঁকতে থাকা সতীর্থ ব্যাটসম্যানদের আড়াল করার চেয়ে নিজেই পালিয়ে গেল যেন। ও যেহেতু ফর্মে আছে, উচিত ছিল তিন নম্বরে উঠে আসা। সেখানে গিয়ে নতুন বলটা খেলে দিতে পারলে ম্যাচের পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। দুঃখজনক হচ্ছে, সেই সিদ্ধান্তটি নিতে পারেনি মিসবাহ।

ঠিক জায়গায় ঠিক খেলোয়াড়কে সুযোগ দেওয়ার পর তারা ব্যর্থ হলেও প্রশ্ন তুলবে না কেউ। কিন্তু যখন ব্যাটিং লাইনআপ নিয়ে প্রতিনিয়ত অদল-বদল করবেন; বোঝা যাবে যে, কী করছেন সে সম্পর্কে নিজেরই কোনো ধারণা নেই। অমন এলোমেলো ক্রিকেট খেলার দিন পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। এখন প্রতিটি দল প্রতিপক্ষ নিয়ে করে বিস্তারিত হোমওয়ার্ক। পাকিস্তানকে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দারুণভাবে করেছে যা।

পাকিস্তানের ২৫ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর জয়ের সম্ভাবনা দিবাস্বপ্নে দৈবের প্রত্যাশার মতো। শোয়েব মাকসুদ ও উমর আকমলের ফিফটিও বিশাল হারের ব্যবধান খুব একটা কমাতে পারেনি। পাকিস্তানের আট ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলার পরিকল্পনা ভীষণভাবে মার খাওয়ার প্রমাণ তাতে।

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম খেলায় হেরেছিল দুটো দলই। ক্যারিবিয়ানদের হার যেহেতু ছিল আয়ারল্যান্ডের কাছে, ওদের ওপর বেশি চাপ থাকার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানকেই বরং মনে হয়েছে বেশি স্নায়ুচাপে ভোগা দল। এর প্রতিফলন ফিল্ডিংয়ে, যেখানে ক্যাচের পর ক্যাচ ফেলেছে তারা। ফিল্ডিং যদি এমন থাকে, আমার তো ভয় হয়, সামনের ম্যাচগুলোতে কমশক্তির দলগুলোও বড্ড ভোগাবে পাকিস্তানকে।

তবে দুটো বাজে ম্যাচ খেলার অর্থ এই না যে, বিশ্বকাপ থেকে পাকিস্তান ছিটকে গেছে। সেমি-ফাইনাল, ফাইনালের কথা ভুলে আপাতত নকআউট পর্বে ওঠাতে তাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। আর সেখানে উঠতে হলে গ্রুপের বাকি চার ম্যাচের মধ্যে অন্তত তিনটিতে তো জিততেই হবে।

পাকিস্তানের বিশ্বকাপ অভিযানে গতি আনার জন্য এখন একটি ভালো জয় বড় প্রয়োজন। সেজন্য আমি সামনের ম্যাচগুলোর একাদশে স্পেশালিস্ট জায়গায় স্পেশালিস্টদের দেখতে চাই। এর জন্য যত মূল্যই দিতে হোক না কেন!

- আইসিসির সৌজন্যে