কোনো টুর্নামেন্টে আমাদের গোনায় ধরেনি কেউ: মাহেলা

টেস্ট, টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছেন আগেই। বিশ্বকাপের পর ছাড়বেন ওয়ানডেও। সেই শেষটা রাঙিয়ে দেওয়ায় চেষ্টার কমতি নিশ্চয়ই থাকবে না মাহেলা জয়াবর্ধনের। বিশ্বকাপ শুরুর পর ইএসপিএন-ক্রিকইনফোকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কার ধীরগতির শুরু, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের ক্রিকেটারদের সময় নেওয়ার কারণ, নিজের অবসরসহ নানা বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন শ্রীলঙ্কার সাবেক এই অধিনায়ক।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2015, 05:50 PM
Updated : 21 Feb 2015, 05:50 PM

প্রশ্ন: বিশ্বকাপের শুরুটা খুব ভালো হয়নি। এখন দলের আবহটা কেমন?

মাহেলা জয়াবর্ধনে: আমাদের বুঝতে হবে যে, বিশ্বকাপটি পাঁচ-ছয় সপ্তাহের দীর্ঘ টুর্নামেন্ট। ছেলেদের তাই বলছি যে, ধৈর্য ধরতে হবে। গত বছর জুড়ে আমরা ভালো ক্রিকেট খেলেছি। নিউ জিল্যান্ডে প্রস্তুতি হয়তো আরেকটু ভালো হতে পারত। তবে চোট ও অন্যান্য সমস্যা মিলিয়ে সেটি খারাপ হয়নি একেবারে।

প্রশ্ন: গত বছরে শ্রীলঙ্কা দারুণ খেলেছে। এখন এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে ম্যাচ জিততে পারছেন না। এটি কি চমকে দেওয়া মতো ব্যাপার না?

জয়াবর্ধনে: না জেতাটা উদ্বেগের তো বটেই। এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আতঙ্কিত না হয়ে কেন জিততে পারছি না সেই বিশ্লেষণ করা। ফিল্ডিংয়ে আমাদের উন্নতি করতে হবে। লাসিথ মালিঙ্গা, সুরাঙ্গা লাকমালরা চোট থেকে ফিরেছে মাত্র। ওদের ছন্দে ফেরায় সময় দিতে হবে আরেকটু। সচিত্রা সেনানায়েকেকেও যেমন। ব্যাটিংয়ে টুকটাক কিছু করার আছে।

প্রশ্ন: বিশ্বকাপ ঘিরে পরিকল্পনা তো অনেকদিনের। তবু আপনার কি মনে হয়, বিশ্বকাপে আসতে আসতে অনেক ক্রিকেটার ফর্ম হারিয়ে ফেলেছে?

জয়াবর্ধনে: আমার তা মনে হয় না। গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রা তো চোটের কারণে দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিল। রঙ্গনা হেরাথ ভালো বোলিং করছে। নুয়ান কুলাসেকেরাও। পার্ট টাইমাররা মন্দ না। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে আমাদের প্রথম ম্যাচটি দেখুন। ওদের যে তিন ব্যাটসম্যান ফিফটি করেছে, সবাই কিন্তু সুযোগ দিয়েছিল। ওই ক্যাচগুলো আমরা নিতে পারলে ম্যাচের ফল অন্যরকম হতে পারত।

প্রশ্ন: আগের সফল টুর্নামেন্টগুলো থেকে আপনারা কি অনুপ্রেরণা নিচ্ছেন এখন?

জয়াবর্ধনে: এই দলের বেশিরভাগ ক্রিকেটার কিন্তু জাতীয় দলে আছে অনেক দিন ধরে। বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আমাদের ধীরগতির শুরুটা ওরা দেখেছে। সর্বশেষ আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি কিংবা বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে সেটি সত্যি। এমন অবস্থায় আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রেখে এগুতে হবে। সমন্বয়টা হতে হবে আরো ভালো। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা হয়তো পারফর্ম করছি কিন্তু বড় ম্যাচে দল হিসেবে জ্বলে উঠতে হবে আমাদের।

প্রশ্ন: এই বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে সেভাবে গোনায় ধরছে না কেউ। আপনি কি মনে করেন, ট্রফি জয়ের সামর্থ্য এই স্কোয়াডের রয়েছে?

জয়াবর্ধনে: অবশ্যই। আর আগেও তো কোনো টুর্নামেন্টে আমাদের গোনায় ধরেনি কেউ। এমনকি শ্রীলঙ্কানরাও আমাদের সেভাবে মূল্যায়ন করে না। এটির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আমরা লড়াই করি, ভুল প্রমাণ করি লোকদের। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে কন্ডিশনে খেলা আমাদের জন্য সহজ না। কিছু ম্যাচে হয়তো হারতে হবে। কিন্তু আমরা চাই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত জিতে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলো জেতা।

প্রশ্ন: বিশ্বকাপের বেশ আগে থেকেই তো নিউ জিল্যান্ডে আছেন আপনারা। এত দিন সেখানে থেকে শ্রীলঙ্কা আসলে শিখেছে কী?

জয়াবর্ধনে: এখানে আবহাওয়া ও উইকেট বেশ ভালো। বড় বড় রান হচ্ছে তাই। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সাত ম্যাচের যে ওয়ানডে সিরিজ খেলেছি, সেখানে হেরে যাওয়া ম্যাচগুলোর মধ্যে দু-একটি অন্তত জেতা উচিত ছিল। চোটের কারণে হোক কিংবা বিশ্বকাপের আগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য- ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে খেলার চেষ্টা করেছি আমরা। এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে তা। কারণ এখন আমরা জানি কী কী করা যাবে, কী কী করা যাবে না।

কৌশলের দিক দিয়ে এই কন্ডিশনে আমাদের আরো চৌকস হতে হবে। কিছু সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। কিন্তু যদি নিজেদের ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলতে পারি, ওই সীমাবদ্ধতা নিয়েও ম্যাচ জেতার সামর্থ্য আছে শ্রীলঙ্কার। আমাদের ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার বোলার নেই যারা এই উইকেট থেকে বাড়তি বাউন্স আদায় করে নেবে। তবে আমাদের বোলারদের সুযোগ তৈরির সামর্থ্য আছে ঠিকই। গত বছর ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির শিরোপা জিতেছি তেমন বড় কোনো পাওয়ারহিটার ছাড়া। থিসারা পেরেরা ও অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস যা একটু মেরে খেলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড যেভাবে ক্রিকেট খেলে, আমরা তো সেভাবে খেলি না। তবে আমাদের এমন দক্ষ সব ব্যাটসম্যান আছে, যারা নিজেদের মতো খেলেই সফল হবে।

প্রশ্ন: চলতি বিশ্বকাপে ৩০০ যেন ‘পার স্কোর’। অথচ শ্রীলঙ্কার মাটিতে খেলা ওয়ানডে ইনিংসে ৩০০ তো খুব একটা হয় না। এটি কি আপনাদের বিশ্বকাপের পথচলা কঠিন করে তুলেছে আরেকটু?

জয়াবর্ধনে: আমাদের বুঝতে হবে, এখানে এত ৩০০ রান হচ্ছে কেন। কিছু কিছু মাঠ ছোট খুব। দুটো নতুন বলের কারণে শেষ ১৫ ওভারে বোলিং করা কঠিন। হাতে যথেষ্ট উইকেট রেখে যদি প্রথম ৩০-৩৫ ওভার খেলে দিতে পারেন, তাহলে শেষ দিকে রানের গতি বাড়ানো সম্ভব। এ কারণে বোলিংয়ে আবার শুরুর দিকে উইকেট নিতে হবে আর মাঝের ওভারগুলোতেও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিউ জিল্যান্ড করেছে যেমনটা। আমাদের যে ব্যাটিং, তাতে এখানে ৩০০ করাটা কঠিন না। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে কয়েকটি ম্যাচে এর কাছাকাছি গিয়েছিলাম। কিন্তু ইনিংসের শেষটা ভালো করতে পারিনি।

প্রশ্ন: গত বছর শ্রীলঙ্কা জিতেছে ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির মতো বৈশ্বিক আসরের শিরোপা। এই বিশ্বকাপের প্রতি আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেটি কিভাবে বদলে দিয়েছে?

জয়াবর্ধনে: চিন্তার দিক দিয়ে বললে, বদলেছে তো বটেই। আমরা এখন জানি, বড় টুর্নামেন্টের চাপ সামলানোয় এলোমেলো হয়ে গেলে চলবে না। বছরে পর বছর যেভাবে একটু একটু তৈরি হয়েছি, এর প্রতিফলন থাকতে হবে ম্যাচে। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে চাপ নেওয়া চলবে না, তাহলে পারবেন না সহজাত খেলা খেলতে। ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির ফাইনালে কঠিন পরিস্থিতি জয় করে ম্যাচ জিতেছি। এবারো তাই দলের মধ্যে বিশ্বাস আছে।

প্রশ্ন: লাহিরু থিরিমান্নে তো এখন ইনিংস ওপেন করছে। লোয়ার-মিডল অর্ডার শক্তিশালী করার জন্য ব্যাটিং লাইনে অদল-বদলের কোনো চিন্তা কি আছে?

জয়াবর্ধনে: অদল-বদলে সমাধান বলে আমার মনে হয় না। ওই পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়দের মানসিকতাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লাহিরু উপরে ওঠার কারণে এখন যদি আমরা ব্যাটিং লাইনে পরিবর্তন আনি বেশি, তাহলে নানা জায়গায় নানা সমস্যা বেরোতে থাকবে। প্রথম চার-পাঁচজন খুব ভালো ব্যাটিং করছে, যে কারণে শুরুটা ভালো হচ্ছে আমাদের। প্রস্তুতি ম্যাচগুলোয় মিডল অর্ডারে জীবন মেন্ডিস ভালো করেছে, ওর অন্তর্ভুক্তি একাদশের ভারসাম্যও বাড়ায়। থিসারা পেরেরা যদি ব্যাটিং-বোলিংটা সামর্থ্য অনুযায়ী করতে পারে, তাহলে ও ম্যাচউইনার। অনেকগুলো ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জিতে সেটি ও প্রমাণ করেছে। এখন হয়তো ও ফর্ম ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে রয়েছে। যতক্ষণ না তা হচ্ছে, আমরা ভিন্ন ক্রিকেটার ও ভিন্ন সমন্বয়ে চেষ্টা করব।

প্রশ্ন: লাহিরুকে তো মনে হচ্ছে, ব্যাট হাতে যে ভূমিকাই দেওয়া হোক তাতেই পারফর্ম করতে প্রস্তুত। এটি কতটা আশাব্যঞ্জক?

জয়াবর্ধনে: সামনের অনেক দিনের জন্য শ্রীলঙ্কার দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান হতে চলেছে লাহিরু ও অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস। গত দুই-তিন বছর ধরে অ্যাঞ্জি অসাধারণ পারফর্ম করছে। আমি ঠিক জানি না, বিশ্বকাপের পর লাহিরু কোথায় ব্যাটিং করবে। আমার তো মনে হয়, সাঙ্গাকারার ছেড়ে যাওয়া তিন নম্বর পজিশনটি ওর জন্য আদর্শ। এই মুহূর্তে দল ওর কাঁধে তুলে দিয়েছে কঠিন কাজের ভার। সর্বোচ্চটা দিয়ে লাহিরু চেষ্টা করে চলছে।

প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলো ছড়াতে শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরা বেশ সময় নেয়। কেন?

জয়াবর্ধনে: এ নিয়ে আমি অনেকদিন ধরে বলে আসছি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের গঠনপ্রণালীর কারণেই হচ্ছে এমনটা। ওই পর্যায়টা আসলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নয় খুব। দক্ষতা ও মানসিকতায় অন্যান্য দেশগুলোর পর্যায়ে উত্তরণের মতো যথেষ্ট কাজ করা হয় না সেখানে। আমাদের যা আছে সেটি হল সহজাত প্রতিভা। তারা হয়তো রান করছে, কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে? আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যতটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে তারা, ওখানে কি ততটা কঠিন অবস্থায় মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে? আমার উত্তর- না। এ কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে শুরুতে তারা খেই হারিয়ে ফেলে। সেখানে নিজেকে প্রমাণ করতে সময় নেয় অনেক। বছরে বছরে ক্রিকেটের বিবর্ধন হচ্ছে, কিন্তু দেশ হিসেবে আমাদের সেটি হচ্ছে না। অন্যান্য দেশের হচ্ছে বলে তাদের ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় মানিয়ে নিয়ে পারে দ্রুত। আমাদের ছেলেরা সেটি পারে না।

প্রশ্ন: শ্রীলঙ্কার হয়ে এটিই আপনার শেষ টুর্নামেন্ট। নিজের মনের ভেতর এই ব্যাপার খেলা করে কতোটা?

জয়াবর্ধনে: সত্যি বলছি, এটি নিয়ে আমি এখনো ভাবিনি। আমি শুধু বিশ্বকাপে মনোযোগ দিতে চাইছি। টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পর হয়তো তা আমাকে ধাক্কা দেবে। তবে টেস্ট-অবসরের পর থেকেই যেহেতু আমি এজন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি, সেই চিন্তা তাই আমাকে এলোমেলো করতে পারবে না। এপ্রিল-মে মাসে যখন সব শেষ হয়ে যাবে, যখন নিজের বাড়িতে বসে থাকব আমি, তখনই হয়তো মনে হবে- সব তাহলে শেষ হয়ে গেল!