অঘটনের তৃতীয় বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ভারত

বছর চারেক বিরতিতে আরেকটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলে এসেছে প্রায়। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে একাদশ বিশ্বকাপের খেলা মাঠে গড়ানোর আগে ফিরে দেখা যাক ১৯৮৩ সালের আসরটিকে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2015, 12:15 PM
Updated : 10 Feb 2015, 10:56 AM

দুটি বিশ্বকাপ পার হয়েছে; কিন্তু তখনও যেন বিশ্বকাপ ক্রিকেট ঠিক ‘বিশ্বকাপ’ হয়ে ওঠেনি। যে কোন মূল্যে জিততে হবে, হতে হবে সবার সেরা- এই মনোভাব অনুপস্থিত ছিল ১৯৮৩ সালের টুর্নামেন্টেও।

“আমরা ছুটির মেজাজে ভারত ছেড়েছিলাম। লন্ডন পৌঁছানোর পর ক্রিকেটের চেয়ে বাকিংহ্যাম প্যালেস, হাইড পার্ক ও ট্রাফালগার স্কয়ার দেখাও কম আকর্ষণীয় ছিল না”, ভারত দলের সন্দীপ পাতিলের কথাটিই এর প্রমাণ।

অথচ কী আশ্চর্য, লন্ডন দেখতে যাওয়া সেই ভারতীয় দলটিই কিনা জিতল ট্রফি!

ক্রিকেটে অঘটন তো কতই হয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেটও বিশ্ব কাঁপানো অনেক অঘটনের সাক্ষী। কিন্তু ভারতের ১৯৮৩ সালের ট্রফি জয়ের সঙ্গে তুল্য নয় কোনো কিছু। এ তো আর এক ম্যাচে ‘ডেভিড’-এর ‘গোলিয়াথ’ বধ না; রীতিমতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া! তাই অঘটনের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ভারতের হারানো ম্যাচটি।
অবাক করা বিষয় হল, ওই বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচেও কিন্তু কপিল দেবের দল জিতেছিল ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে। তখন সেটিকে পাত্তা দেয়নি খুব বেশি লোক। ফাইনালে এই দল দুটি মুখোমুখি হলে ক্যালিপসো-ক্রোধে ভারতীয়দের পুড়ে ছাই হওয়ার সম্ভাবনাই তাই দেখেছিলেন সিংহভাগ সমর্থক। এক অঘটন কি আর দু’বার ঘটবে? কিন্তু ভারতকে প্রথম বিশ্বকাপ জিতিয়ে ‘কপিলস ডেভিলস’ নাম লেখাল ক্রিকেটীয় রূপকথায়।
ইংল্যান্ডে তৃতীয় বিশ্বকাপের ভাঁজে ভাঁজে অঘটন অবশ্য কম ছিল না। নিজেদের প্রথম এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে জিম্বাবুয়ে যেমন হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে। হারের শঙ্কার মুখে ফেলে দেয় ভারতকেও। কপিলের অবিস্মরণীয় ১৭৫ রানে শেষমেষ শেষরক্ষা হয় তাদের।
প্রথম দুই বিশ্বকাপের মতো ১৯৮৩ আসরের স্বাগতিকও ছিল ইংল্যান্ড। অংশগ্রহণকারী আট দলের মধ্যে এবার আইসিসি ট্রফি পেরিয়ে আসে কেবল জিম্বাবুয়ে। কারণ, শ্রীলঙ্কা তত দিনে পেয়ে গেছে আইসিসির পূর্ণ সদস্য পদ।
বরাবরের মতো ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মে আয়োজিত হলেও এই টুর্নামেন্টের ফরম্যাটে আসে পরিবর্তন। দ্বিতীয় টুর্নামেন্টে আবহাওয়া বেশ ঝামেলা করায় এবার গ্রুপ পর্বের খেলাগুলো হয় ডাবল-লিগের। অর্থাৎ গ্রুপে সবার সঙ্গে সবার দুবার করে খেলা। যে কারণে টুর্নামেন্টের মোট ম্যাচের সংখ্যাও যায় বেড়ে। আগের দুই বিশ্বকাপে যেখানে তা ছিল ১৫টি করে, এবার সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ২৭-এ।
পরিবর্তন আসে ফিল্ডিংয়ের নিয়মেও। স্ট্যাম্পের ৩০ গজের মধ্যে একটি ডিম্বাকৃতি বৃত্ত এঁকে দেওয়া হয়। যার ভেতর পুরো ৬০ ওভারই অন্তত চারজন ফিল্ডার থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। আর ওয়াইড ও বাউন্সারের ব্যাপারে আম্পায়ারদের কঠোর হওয়ার নির্দেশনাও ছিল আইসিসির তরফ থেকে। ফলে আগের বিশ্বকাপের চেয়ে ম্যাচপ্রতি ওয়াইডের সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় দ্বিগুণ (১৯৭৯ সালে ম্যাচপ্রতি ৪.৬৪; ১৯৮৩ সালে ৯.৫৯)। তৃতীয় বিশ্বকাপে এসে প্রথমবারের মতো ম্যাচ আয়োজন করার জন্য ব্যবহার করা হয় এমন কয়েকটি মাঠ, যেখানে আগে কখনো টেস্ট ম্যাচ হয়নি।
‘এ’ গ্রুপের ম্যাচে অঘটন বলতে ছিল টেস্ট পরিবারের নতুন সদস্য শ্রীলঙ্কার নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়া। ওদিকে নিজেদের ছয় ম্যাচের মধ্যে নিউ জিল্যান্ডের কাছে কেবল এক ম্যাচে হারে ইংল্যান্ড। পাঁচ জয় নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমি-ফাইনালে উঠতে তাদের সমস্যা হয়নি।
ইংলিশদের সঙ্গী হওয়ার লড়াইটা ছিল জম্পেশ। পাকিস্তান ও নিউ জিল্যান্ড দুই দলই জেতে তিনটি করে ম্যাচ। রান রেটে নিউ জিল্যান্ডের (৩.৯২৭) চেয়ে সামান্য এগিয়ে পাকিস্তান (৪.০১৪) পেয়ে যায় সেমি-ফাইনালের টিকেট।
‘বি’ গ্রুপ সাজিয়ে বসেছিল অঘটনের পসরা। নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ তো বটেই, প্রথম এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমে জিম্বাবুয়ে হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে। ট্রেন্ট ব্রিজের আগে ব্যাটিং করে ৬০ ওভারে ছয় উইকেটে ২৩৯ রান তোলে জিম্বাবুয়ে। বাতাসে তখনো নেই অঘটনের গন্ধ। কিন্তু ব্যাট হাতে অপরাজিত ৬৯ রান করা ডানকান ফ্লেচার বোলিংয়েও ৪২ রানে চার উইকেট নিলে আফ্রিকান দেশটি পায় অবিস্মরণীয় জয়। ১৩ রানে হারা অস্ট্রেলিয়ার ওই দলের সদস্য কেপলার ওয়েসেলস পরে স্বীকার করেছেন, “হয়তো ওদের আমরা হালকাভাবে নিয়েছিলাম। ভাবিনি যে, আমাদের জয়ের পথে ওরা বাধা হতে পারবে।”
এছাড়া ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভারতের ৩৪ রানের জয়েরও আগাম পূর্বাভাস ছিল না। এর আগের দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন ক্যারিবিয়ানদের সেটি ছিল এই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ। এই ধাক্কা সামলে পরের পাঁচ ম্যাচ টানা জিতে সেমি-ফাইনালে অবশ্য স্বচ্ছন্দ্যেই উঠে যায় তারা। চার জয় নিয়ে তাদের সঙ্গী ভারত। অবশ্য সমীকরণটা এত সহজ থাকত না যদি জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে যেত দলটি। ১৭ রানে পাঁচ এবং ৭৮ রানের মধ্যে ভারতের সাত উইকেট ফেলে দিয়ে সেই সম্ভাবনাও রচনা করেছিল ফ্লেচারের দল। কিন্তু বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস খেলে জিম্বাবুয়েকে দ্বিতীয় অঘটন ঘটাতে দেননি কপিল দেব। তার অবিশ্বাস্য ১৩৮ বলে অপরাজিত ১৭৫ রানের ইনিংসে জয়ের ভিত্তি পেয়ে যায় ভারত। বিবর্ণ অস্ট্রেলিয়াকে পেছন ফেলে সহজেই তারা উঠে যায় সেমিতে।
প্রত্যাশাহীন বিশ্বকাপে শেষ চারে উঠতে পেরেই খুশি ছিল ভারত। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সেমি-ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ছয় উইকেটে হারিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই তারা উঠে যায় ফাইনালে। ওদিকে শিরোপার মঞ্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উপস্থিতি ততদিনে প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। আগের দুই আসরের ধারাবাহিকতায় এবারও ফাইনালে ওঠে তারা। এবার শেষ চারে পাকিস্তানকে তারা আট উইকেটে উড়িয়ে দেয়।
২৫ জুন ১৯৮৩; লর্ডসের ফাইনালে মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ভারত। গ্যালারিতে উপস্থিতি হাজার ত্রিশেক দর্শকের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা কম ছিল না। কিন্তু শিরোপা জেতার আশা তারাও খুব একটা করেনি। আর অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংয়ের পেস ব্যাটারির সামনে ভারত ১৮৩ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পর তো আরো না। গ্যালারিতে তখন ক্যালিপসোর সুর মুর্ছনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকরা মাতোয়ারা। টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ছিল যেন কেবলই সময়ের ব্যাপার!
গড়পড়তা ব্যাটিং শেষে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে পিনপতন নীরবতা। এত কাছে এসেও ট্রফি জিততে না পারায় আগাম বেদনা খেলোয়াড়দের চোখে-মুখে। এমন সময় দলকে নিয়ে ফিল্ডিংয়ে যাওয়ার আগে অধিনায়ক কপিল দেব দিলেন সেই অমর ক্রিকেটীয় বাণী, “ছেলেরা, আমাদের স্কোর যদি ম্যাচ জেতার মতো না-ও হয়, লড়াই করার মতো তো বটেই। এসো আমরা সেই লড়াইটাই করি।”
তা ভারত লড়াই করলও বটে। আর তাতে সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী ভূমিকা অধিনায়কের। ড্রেসিংরুমে উজ্জীবনী ওই ভাষণেই শুধু না, ভিভ রিচার্ডসের অবিশ্বাস্য ক্যাচটি ধরেও। ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতে গর্ডন গ্রিনিজকে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর রিচার্ডস নেমেই শুরু করেন তাণ্ডব। মাত্র ২৭ বলে ৩৩ রান করে জয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন দলকে। কিন্তু এরপর মিডিয়াম পেসার মদনলালকে হুক করতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় হয়ে যায়। তবু শূন্যে উঠে যাওয়া রিচার্ডসের বলটি নিরাপদেই ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ পড়বে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু মিড উইকেটে প্রায় ২০ গজ পেছন দিকে দৌড়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন কপিল। ম্যাচের মোড় তাতেই যায় ঘুরে।
মদনলাল-মহিন্দার অমরনাথদের মতো মিডিয়াম পেস বোলারদের সামনে আত্মাহুতির মিছিলে সামিল হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কালজয়ী ব্যাটিং লাইন; মাত্র ১৪০ রানে অলআউট তারা। ব্যাটিংয়ে ২৬ রান করা অমরনাথ বোলিংয়ে সাত ওভারে ১২ রান দিয়ে নেন তিন উইকেট। সেমি-ফাইনালের মতো ফাইনালেও তাই তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ।

সবচেয়ে বেশি রান:

খেলোয়াড়

দেশ

ম্যাচ

রান

সেরা

গড়

১০০/৫০

 

ডেভিড গাওয়ার

ইংল্যান্ড

৩৮৪

১৩০

৭৬.৮০

১/১

 

ভিভ রিচার্ডস

ও.ইন্ডিজ

৩৬৭

১১৯

৭৩.৪০

১/২

 

গ্রাহাম ফাওলার

ইংল্যান্ড

৩৬০

৮১*

৭২.০০

০/৪

 

জহির আব্বাস

পাকিস্তান

৩১৩

১০৩*

৬২.৬০

১/২

 

কপিল দেব

ভারত

৩০৩

১৭৫*

৬০.৬০

১/০

 

সবচেয়ে বেশি উইকেট:

খেলোয়াড়

দেশ

ম্যাচ

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

রজার বিনি

ভারত

১৮

৪/২৯

১৮.৬৬

৩.৮১

অশান্ত ডি মেল

শ্রীলঙ্কা

১৭

৫/৩২

১৫.৫৮

৪.০১

মদন লাল

ভারত

১৭

৪/২০

১৬.৭৬

৩.৪৩

রিচার্ড হ্যাডলি

নিউজি

১৪

৫/২৫

১২.৮৫

২.৭৬

ভিক মার্কস

ইংল্যান্ড

১৩

৫/৩৯

১৮.৯২

৩.১৫