এমনিতে সংবাদ মাধ্যমের সামনে কথা বলেন কমই। বেশিরভাগ সময় শেষ করেন অল্প কথায়। কিন্তু সোমবার দুপুরে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে মেলে ধরলেন কথার ঝুড়ি।
ক্লান্তির কারণে ছুটি চেয়েছেন বলে জানিয়েছে বিসিবি। আমরা আপনার কাছ থেকে আপনার অবস্থানটা জানতে চাই।
সাকিব আল হাসান: সব থেকে বড় কারণ হচ্ছে, আমি মনে করি আমার আরও বেশ অনেকদিন খেলা বাকি আছে। আমি যদি ওটা খেলতে চাই এবং ভালোভাবে খেলতে চাই, তাহলে এই বিশ্রামটা আমার জরুরি।
আমি চাইলেই খেলতে পারি। কথা হচ্ছে, আপনারা কি চান যে আমি আরও ৫-৬ বছর খেলি নাকি ১-২ বছর? নির্ভর করছে সেটার ওপর। আমি যেটা অনুভব করি, এভাবে খেলতে থাকলে ১-২ বছরের বেশি খেলতে পারব না। ওভাবে খেলা থেকে না খেলা আমার কাছে ভালো। যতদিন খেলব, ততদিন যেন ভালোভাবে খেলতে পারি। সেটিই লক্ষ্য আমার।
সেই কারণেই এই বিরতি পেলে আমি আবার তরতাজা হয়ে, শারীরিকভাবে যতটা না, তার চেয়ে বেশি মানসিকভাবে চাঙা হয়ে ফিরলে, হয়তো পরের ৫ বছর আমার টেনশন ছাড়া খেলা সম্ভব হবে। যেটা আমি মনে করি বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি-দুটি ম্যাচ বা একটি-দুটি মাস না খেলা থেকে।
দুটি টেস্টের বিরতি কি আসলে খুব বেশি কাজে দেবে?
যেভাবে আপনাদের মাত্র বললাম, আমি তাদেরকে সেটি বুঝিয়ে বলার পর, তারা বলেছে যে “ঠিক আছে, আইডিয়া ভালো আছে।” কারণ দিন শেষে আমার শরীর যে কারও চেয়ে আমিই ভালো বুঝতে পারব। আমার এটা ম্যানেজ করার দরকার আছে। এই কারণেই এই সিদ্ধান্ত।
বিসিবিকে বোঝানো কতটা কঠিন ছিল?
সাকিব: খুব যে কঠিন ছিল বোর্ডকে বোঝানো, তা নয়। সুবিধা যেটা ছিল যে, আমি যখন কথা বলেছি, যাদের সঙ্গে বলেছি, আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা বলার পর মনে হয়নি যে এটি অনৈতিক কিছু। সে কারণেই তারা হয়ত এটি গ্রহণ করেছে।
আগেও চোট বা নিষেধাজ্ঞার বা নানা কারণে মাঝেমধ্যে খেলতে পারেননি। এবার নিজে থেকেই বিরতি নিচ্ছেন…
সাকিব: বিরতিটা নেওয়ার এটাই বড় কারণ, আমার যেন ওই অনুভূতি থাকে যে আমি খেলব ও ভালো করব। কিংবা খেলার প্রতি ভালোবাসা থাকলে বাড়তি কিছু করার আগ্রহ থাকে। ওই আগ্রহটা যেন পাই।
৬ মাসের চেয়েছিলেন, ছুটি পেয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সফরের দুটি টেস্ট থেকে। শ্রীলঙ্কা সিরিজ নিয়ে তাহলে আপনার ভাবনা কি?
সাকিব: ৬ মাসের জন্যই আবেদন করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর দুটি টেস্ট ম্যাচ আছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এখন পর্যন্ত এবারের দুটি টেস্ট অনুমতি দিয়েছে। এরপর যখন খেলা শুরু হয়ে যাবে... দক্ষিণ আফ্রিকা, বিপিএল হবে, তার পর ওই সময়টা চিন্তা করব যে ওই দুটি টেস্ট খেলব কী খেলব না। সেভাবে কথা বলব তখন। তার পর যদি তারা মনে করে যে আমার খেলার দরকার বা আমার নিজের যদি মনে হয় যে মানসিকভাবে এমন অবস্থায় আছি যে পুরোটা দিতে পারব, তখন অবশ্যই খেলব।
বিশ্রামটা টেস্ট সিরিজ থেকে না হয়ে কি সীমিত ওভারে নিতে পারতেন না?
সাকিব: সীমিত ওভারের খেলা ১ ঘণ্টার হয় বা ৩ ঘণ্টার হয়। টেস্ট ম্যাচ ৫ দিনের হয়, প্রস্তুতি আরও ১০-১৫ দিনের হয়, প্রস্তুতি ম্যাচ ৩ দিনের থাকে। তো একটি টেস্ট সিরিজ থেকে বিশ্রাম নিলে পাওয়া যায় এক মাসের বিরতি। টি-টোয়েন্টি থেকে বিশ্রাম নিলে পাওয়া যায় ৩ দিনের বিরতি, ওয়ানডে সিরিজ থেকে বিশ্রাম নিলে পাওয়া যাবে ৭ দিনের বিরতি। আমার একটু বড় বিরতি দরকার। এই কারণেই টেস্ট সিরিজে বিশ্রাম।
আপনি, এবি ডি ভিলিয়ার্স বা ক্রিস গেইল, আপনারা যারা বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েনিট খেলেন, তাদের বিরুদ্ধে একটা সমালোচনা আছে যে টি-টোয়েন্টিকে বেশি প্রধান্য দেন। আপনি কিভাবে দেখেন এটা?
টেস্ট ম্যাচে আমার যেটা হয় যে, যেহেতু আমি ব্যাটিং-বোলিং দুটিই করি, চারটা ইনিংসেই আমার অবদান রাখার দরকার হয়। দলও আশা করে। যদি আমি অর্ধেক অবদান রাখতে পারলাম, অর্ধেক পারলাম না, তাহলে দল যেটা আশা করে, সেটা তো পুরোটা দিতে পারলাম না। পুরোটা না দিতে পারা আমার মনে হয় না ভালো দিক।
আমি যখন চারটা ইনিংসেই ভালো করতে পারব, এবং আমার মনে হবে সেই সামর্থ্য আমার আছে বা সেই ইচ্ছাও থাকবে, তখনই খেলার সেরা সময়। আমিতো চাইলেই খেলতে পারি। ম্যাচ ফি পাব, পারিশ্রমিক পাব। সবই পাব। কিন্তু ওভাবে খেলাটা আমার মনে হয় না খুব একটা গুরুত্ব বহন করে। ঠিক আছে, এটা আমার চাকরি। কিন্তু দিন শেষে এখানে আমার আগ্রহ, আমার প্যাশন, ভালোবাসা থেকেই খেলাটা শুরু করা। ওইটা যদি না থাকে, ওই খেলাটার মানে আছে বলে মনে করি না।
বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিয়ে কতদিন ধরে ভাবছিলেন?
সাকিব: বেশ কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছে। এটা আমি আগে আলোচনাও করেছি। এমনকি এই টেস্ট সিরিজের আগে কথা বলে রেখেছি। আমার পরিবারের সঙ্গে… পরিবার বলতে স্ত্রীর সঙ্গে এবং আমার কাছের যারা আছে, সবাই জানত যে আমি এরকম চিন্তা করছি। আমি মনে করি, এটা আমার জন্য উপকারী হবে।
যেহেতু অনেক বেশি খেলা হয়, আমার ফিটনেসটাও (ট্রেনিং) ওভাবে করা হয় না বা করা হলেও মানসিকভাবে চাঙা থাকার যে ব্যাপারটি আছে, সেটি হয় না। এমন তো নয় যে দু-একদিন খেলেই ছেড়ে দিচ্ছি। ১০-১১ বছর হয়ে গেল, একটি বিরতি তো নিতেই পারি। এটা আমার প্রাপ্য।
বিশ্ব ক্রিকেটে অনেকেই টেস্ট ছেড়ে দিয়ে শুধু রঙিন পোশাকে খেলছে। আপনার ওরকম কোনো ভাবনা আছে?
সাকিব: এমন তো নয় যে আমি আর ক্রিকেটই খেলছি না! অবশ্যই খেলব। কেন খেলব না! আমার ইচ্ছে আছে, সবার পরে টেস্ট থেকে অবসর নেব। তার আগে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে থেকে অবসর নেব। সবার শেষে টেস্ট থেকে। কিন্তু আমার মনের কথা সবসময় সবাইকে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। আমার ভেতরে কি আছে, আমি জানি। এবং লোকে যেমন সচেতন, আমিও সচেতন যে কী করলে ভালো হয়, কী করা যায়। আমি ওভাবেই চেষ্টা করব।
গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যে, আমার কাছে মনে হয়, স্রেফ খেলার জন্য ২-১ বছর খেলার থেকে ৫ বছর মন দিয়ে খেলা বেশি জরুরি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় দল আপনাকে কতটা মিস করবে বলে মনে হয়?
সাকিব: আমার থাকা না থাকায় খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ দুনিয়াতে কোনো জিনিসই কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আমি আশা করি এবং মন থেকে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ অনেক ভালো করবে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ধারাটা অব্যাহত থাকবে। যে যাবে, সে ভালো করবে। দক্ষিণ আফ্রিকা সবার জন্য চ্যালেঞ্জিং। সবার ভেতর বাড়তি চেষ্টাও থাকবে ভালো করার।
দক্ষিণ আফ্রিকা খুবই চ্যালেঞ্জিং, এটা তো সবাই বলছে। তাহলে বিশ্রামটা কি দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পরে নিলে হতো না?
যার যার অবস্থানটা কিন্তু সেই ভালো বুঝতে পারে। অন্য কারো পক্ষে এতটা বোঝা সম্ভব না। অনেকের অনেক মন্তব্য তাই থাকবে। অনেক মত থাকবে। সেগুলো তাদের মত, তাদের চিন্তা ভাবনা। আমার কাছে আমার মত থাকবে। আর যেহেতু আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার কাছে মনে হয় অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত। এবং এটা অবশ্যই ভালো কিছু ফল দেবে।
দেশের হয়ে দিনের পর দিন প্রায় সব ম্যাচ খেলেছেন। টেস্টে অনেক ওভার বোলিং করতে হয়, আবার ব্যাটিং…চাপটা কি বেশি হয়ে গিয়েছিল?
সাকিব: এটা বলা মুশকিল। এমন নয় যে আমি বোলিং করতে পছন্দ করি না। অনেক বোলিং করতে পছন্দ করি। চেষ্টা তো থাকে যে সবার আগে ব্যাটিংয়ে নেমে সবার শেষ পর্যন্ত থাকি। মাঠেও থাকার চেষ্টা করি সবসময়। যখন মাঠে থাকি, শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করি। যখন মনে হয় যে আমি হয়ত শতভাগ দিতে পারব না পুরোটা সময়, তখনই বিরতির কথা মাথায় আসে। ওখান থেকেই এই ভাবনাটা শুরু।
এ বছর আইপিএল বা সিপিএলে আপনি খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি। ক্লান্তি বা অবসাদ আসলেই কতটা আছে, এই প্রশ্নও তুলতে পারে অনেকে।
সাকিব: লোকে সমালোচনা করবে, সেটা তো স্বাভাবিক। দুনিয়াতে কোনো কিছুই এমন নয় যে কেউ বলল আর সবাই সেটার সঙ্গে একমত হলো। সেটা কখনোই হয় না। স্বাভাবিকভাবেই আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সবাই একমত হবে না। তবে যেটা বললাম, আমার দিক থেকে আমি বলেছি। এগুলো নিয়ে খুব বেশি মন্তব্য করার কিছু নেই।
দলের অন্য কেউ যদি এভাবে ক্লান্তির কথা ভাবে, তার প্রতি পরামর্শ কি থাকবে?
সাকিব: যদি কখনও কারও মনে হয় যে আমার আসলে খেলা বেশি হয়ে যাচ্ছে বা বেশি খেলেছি, একটি বিরতি দরকার, আমি মনে করি তাদের অবশ্যই মন থেকে বলা উচিত। এটায় বরং তাদের ক্যারিয়ার আরও ভালোই হতে পারে। ধরুন আমার এখন ইচ্ছে হচ্ছে না, তবু জোর করে খেললাম, ভালো করতে না পারলে আপনারই বলবেন আমাকে বাদ দেওয়া হোক। স্বাভাবিক না? কি দরকার আছে ওটার! যতদিন খেলব, চেষ্টা থাকবে ভালো ভাবে খেলার।
দেশের সাবেক ক্রিকেটারদের অনেকে আপনার চাওয়ার সঙ্গে একমত। পাশাপাশি এটা বলছেন যে ভবিষ্যতে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটও যেন বেছে বেছে খেলেন সাকিব…
সাকিব: আপাতত এ বিষয়ে আমার ভাবনা নেই। তাদের ভাবনা তাদের কাছে থাক, তারা যেটা মনে করল… ওই যে বললাম না, লোকের ধারণা একেকরকম হবেই। সেসব নিয়ে চললে আমার জন্য লাভজনক বা ভালো কিছু হবে না। আমার চিন্তাটা আমিই করি। আমার চিন্তা আমি করলেই সব থেকে ভালো হয়। আমি যেন ভালোভাবে চিন্তা করতে পারি, এই সাপোর্ট আপনারা করবেন।
ছুটির সময়টুকু কিভাবে কাটাবেন, ভেবেছেন?
সাকিব: জানি না। পরিবারের সঙ্গে সময়…ঘুরতে যাওয়া..। পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। মাঝেমধ্যে ক্রিকেট থেকে বাইরে থাকা খুবই জরুরি। চেস্টা থাকবে যত বেশি বাইরে থাকতে পারি। যেহেতু ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি আছে, সেটির প্রস্তুতিও শুরু করব। কিন্তু কয়েক দিন পর।