উপভোগের মন্ত্রে ইতিহাসের মঞ্চে

“প্রেস কনফারেন্সে কণ্ঠ এমন ম্রিয়মান শোনাল, ভালোই তো চাপে পড়ে গেছেন!” বোলিং অনুশীলনের আগে গা গরম করছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকালেন, “আরে নাহ, অনেক লম্বা ঘুম দিয়েছি। সেটির রেশ এখনও আছে। চাপ আবার কী!”

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনি বার্মিংহাম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2017, 05:46 PM
Updated : 14 June 2017, 05:46 PM

চাপ কি, এটা অবশ্য চিরন্তন প্রশ্ন। চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। এই মুহূর্তে যেটি অনুভব প্রবলভাবে করার কথা বাংলাদেশ, ভারত দুই দলের ক্রিকেটারদেরই।

ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে দুই দলের অধিনায়কই চাপকে পাত্তা না দেওয়ার কথা বললেন বারবার। আগের দিন বাংলাদেশ কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহেও একই কথা বলেছেন ঘুরেফিরে। চাপ সরানোর জন্য যখন এত কথা আর আয়োজন, তখন আরও ভালো করে বোঝা যায় চাপের তীব্রতা!

বাংলাদেশ-ভারতের লড়াই গত দুবছর যতটা উত্তেজনা ছড়িয়েছে, যতটা রোমাঞ্চ, বিতর্কের শাখা-প্রশাখায় যত টান পড়েছে, তাতে এই দুই দেশের প্রতিটি লড়াই এখন ‘হাই-ভোল্টেজ।’ আর এটি তো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনাল!

লাইন আপ ঠিক হওয়ার পর থেকেই বাতাসে উড়ছে উত্তেজনার রেণু, ছড়াচ্ছে বারুদের গন্ধ, বাজছে দামামা।

সেই দামামা মাশরাফি ও হাথুরুসিংহের কানে ঢুকেছে স্বাভাবিক নিয়মেই। তবে দুজনের কেউই সেটিকে মাথায় আর মনে ঠাঁই দিতে চান না। উত্তেজনার আঁচ ঢুকেছে বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমেও। তবে ক্রিকেটারদের জড়িয়ে রাখা হচ্ছে শীতল তোয়ালেতে। আর সবার মনে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে একটি মন্ত্র, ‘উপভোগ।’

চাপের তীর থেকে নিজেদের আড়াল করার একটি বর্ম বের করেছে বাংলাদেশ দল। এই ম্যাচ থেকে হারানোর আছে সামান্য, পাওয়ার আছে অনেক কিছু। এমনিতে সেমি-ফাইনাল ম্যাচ মানে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানোর ব্যাপার থাকে বেশ। তবে বাংলদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। কঠিন গ্রুপ থেকে সেমি-ফাইনালে উঠতে পেরেই প্রাপ্তির পাল্লা উপচে পড়ছে। এরপর কিছু পেলে সেটি হবে সোনায় সোহাগা। না পেলেও হাসি থাকবে অটুট।

চাপ আসে প্রত্যাশার হাত ধরে। হারানোর কিছু না থাকা মানে চাপও উধাও। ড্রেসিং রুমে যে বার্তা দিয়েছেন, মাশরাফি সেই বার্তা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন আর সবার মাঝেও।

“এই ম্যাচের হাইপ অনেক থাকবে এটা সত্যি। তবে আরেকটা ম্যাচ হিসেবেই নিতে চেষ্টা করব আমরা। আমাদের প্রথম কাজ হবে রিল্যাক্সড থেকে ম্যাচটি খেলা।”

“ছেলেরা বেশ রোমাঞ্চিত, এরকম একটা টুর্নামেন্টের সেমি-ফাইনাল খেলছি। এখানে আসার আগেই টুর্নামেন্টটিকে আমরা প্রতিটি ম্যাচ হিসেবে নিতে চেয়েছিলাম। সেভাবেই খেলেছি। এখন সেমি-ফাইনাল খেলছি। সবাই যদি সেমি-ফাইনাল না ভেবে আর দশটা ম্যাচের মত খেলতে পারে, তাহলে ভালো।”

আগের দিন হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, বাংলাদেশর জন্য এটি বড় ম্যাচ নয়, বড় সুযোগ। চাপ দূরে সরানোর বাংলাদেশ কোচের মন্ত্র জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশ। এখানে সবার মুখে মুখেই এই কথা। সুযোগটা অনেক বড় কিছু্র। ইতিহাসের নতুন দিগন্তে পা রাখার পর সেটির সীমানা আরও বাড়িয়ে নেওয়া। প্রথম সেমি-ফাইনালের হাত ধরেই প্রথমবার ফাইনাল!

ভারতকে সামনে না পেলে হয়ত সেই সম্ভাবনা বাড়ত আরও। ভারত ম্যাচ মানেই এখন অনন্ত চাপ। নানান মন্ত্রে দূরে রাখতে পারলেও তলানি পড়ে থাকা চাপটুকুও তো অনেক!

মাশরাফি অবশ্য এ চাপকেও দেখছেন সুযোগ হিসেবে। এমন ম্যাচ জয় করা মানে পরের ধাপে ওঠার পথেও আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া!

“ক্রিকেট জাতি হিসেবে উন্নতি করতে হলে এই ধরনের ম্যাচ প্রচুর আসবে। এমন একটা টুর্নামেন্টে এসে কাউকে বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। এরকম চাপের ম্যাচ খেলতে হবে। এটা উপভোগ করা ছাড়া বাড়তি চাপ নেওয়া মাথায় রাখা যাবে না। সবাই যদি নির্ভার হয়ে, দ্বিপাক্ষিক সিরিজের মত খেলতে পারি, তাহলে আমাদের কাজ সহজ হবে।”

মানসিক খেলায় খুব একটা আগ্রহী না হলেও এদিন একটু চেষ্টা করলেন মাশরাফি। চাপটা চাপিয়ে দিতে চাইলেন ভারতের ওপরই। তারা ফেভারিট, তাদের দেশে মানুষ বেশি, তাদের প্রত্যাশার ওজনও বেশি ভারী। চাপ তো বেশি বিরাট কোহলিদেরই!

সেটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে চাপ সামলানার অভ্যাসটাও কোহলিদের বেশি। গত ৭টি আইসিসি টুর্নামেন্টের ৬টিতেই সেমি-ফাইনাল খেলল তারা। বাংলাদেশের জন্য যে মঞ্চ রোমাঞ্চকর অচেনা জগত, ভারতের জন্য সেটি স্রেফ পুরোনো মঞ্চে নতুন করে পারফর্ম করা।

ক্রিকেটীয় রোমাঞ্চে অবশ্য বিষাদের ছোঁয়া যোগ হয়েছে দেশ থেকে পাওয়া খবরে। পাহাড় ধসে এত প্রাণহানির খবরে মন খারাপ গোটা দলেরই। জীবন-মৃত্যুর মত ব্যাপারগুলির সঙ্গে কখনোই ক্রিকেট মেলাতে চান না মাশরাফি। ক্রিকেট দিয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া যায় বলেও বিশ্বাস করেন না। তব সমব্যথী হওয়া যায়। সেমি-ফাইনালে নামবে বাংলাদেশ কালো ব্যাজ পরে। চেষ্টা করা যায় ক্রিকেট দিয়ে অন্তত কিছুটা হাসি ফেরানোর। সেই তাড়না থাকবে।

দিনশেষে, মন্ত্র সেই একই। ক্রিকেটীয় চাপকে জয় করতে হোক বা জীবনের খেলায় লাশের মিছিলকে ভুলে থাকা, মাঠে নেমে উপভোগ করতে পারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

মাশরাফিরা যখন মাঠে উপভোগ করেন, উপভোগের উপলক্ষ খুঁজে পায় গোটা দেশই!