‘বুকের ভেতরে আছে প্রত্যয়, আমরা করব জয়’

ড্রেসিং রুমের কোলাহল শোনা যাচ্ছিল বাইরে থেকেই। কেউ একজন চিৎকার করে বলছেন, “এই সবাই চুপ, চুপ। সবাই এক সঙ্গে শুরু কর।” খানিক পর ভেসে এল আনন্দ সঙ্গীত, “আমরা করব জয়, আমরা করব জয়, আমরা করব জয় একদিন…।”

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিকার্ডিফ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2017, 03:32 AM
Updated : 10 June 2017, 08:30 AM

গলা ছেড়ে গেয়েও বুঝি মন ভরছিল না কোনো একজনের। চেঁচিয়ে বললেন, “আরও জোরে, আরও জোরে।” এবার শোনা গেল গর্জন, “আহা বুকের ভেতরে, আছে প্রত্যয়, আমরা করব জয় নিশ্চয়।”

অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ দলের অফিসিয়াল বিজয় সঙ্গীত হয়ে আছে “আমরা করব জয়”। বিশেষ সব জয়ের পরই ড্রেসিং রুমে বিজয়ের নায়ক বা নায়কদের মাঝখানে রেখে গোল হয়ে আয়োজন করে গাওয়া হয় এই গান। এ দিনের গলা ফাটানো তবু যেন বিশেষ কিছু। এ দিনের জয়টি যে বিশেষ কিছু!

এ দিন সত্যিই বুকে ছিল প্রত্যয়। ম্যাচের আগের দিন থেকেই একটা আত্মবিশ্বাস ছিল দলের মধ্যে। বাংলাদেশের স্মরণীয় অনেক জয়ের আগেই দেখা গেছে, দলে জয়ের একটা আবহ ছড়িয়ে পড়ে। সবাই এরকম নিশ্চিত হয়ে যায়, জিততে যাচ্ছি। মাঠে সেই আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন পড়ে।

এই জয়ের আগেও দলের মাঝে ছিল জয়ের ছায়া। ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেরিয়ে অনুশীলনে যেতে যেতে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেছিলেন, “দেখবেন, উড়িয়ে দেব!”

বাংলাদেশ হয়তো নিউ জিল্যান্ডকে উড়িয়ে দেয়নি, তবে গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জয়ের ধরন অবশ্যই আদর্শ হয়নি। ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারাতে চাইবে না কোনো দলই। তবে ওই অবস্থা থেকে জিতেছে বলেই না জয়টা আরও মধুর হয়েছে!

অনেক কারণেই জয়টা খুব জরুরি ছিল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আসার আগে থেকে টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পরও মাশরাফি অনেকবারই বলেছেন, এই কন্ডিশনে এই গ্রুপে একটি ম্যাচ জেতাও কঠিন। তবে ক্রিকেটীয় উন্মাদনার বাংলাদেশে বাস্তবতা বোঝার মতো কজন আছে! অধিনায়কের কথা লোকের কর্ণকুহর ভেদ করে ঢুকতে পেরেছে কমই।

মানুষের লাগামহীন প্রত্যাশা যদি সরাসরি চাপ হয়, সঙ্গে ছিল কিছু অদৃশ্য চাপও। ধারাবাহিক খেলে র‌্যাঙ্কিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেছনে ফেলে যোগ্যতা দিয়েই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলছে বাংলাদেশ। তবু যেন অভিজাত এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের উপস্থিতি হজম করতে সমস্যা হচ্ছিলো কুলীন জগতের অনেকের। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে এই জয় হজম বটিকা হিসেবে কাজ করবে।

জয়ের পর মাশরাফি যেমন বলেছেন, এই ধরনের টুর্নামেন্টে অন্তত একটি ম্যাচ না জিতলে অনেকেই প্রশ্ন তোলে সামর্থ্য-যোগ্যতা নিয়ে। বাঁকা চোখে তাকায়। এই জয় প্রশ্নগুলো চাপা দেবে।

পরপর দুই দিন আন্ডারডগ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার জয়ও ছিল একটা পরোক্ষ চাপ। র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের নীচে থাকা ও পুনর্গঠনের পথে থাকা দল দুটি এমন জয় পেলে বাংলাদেশ কেন নয়। প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিল, এভাবেই হয়!

চার পেসার নিয়ে একাদশ সাজিয়েই বার্তাটা দিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ। খেলতে চায় ইতিবাচক, আগ্রাসী ক্রিকেট। শুরু থেকে মাঠে ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষায়ও ছিল সেসবের প্রতিফলন। বোলিং ছিল গোছানো। ছিল পরিকল্পনা আর প্রতিজ্ঞার ছাপ। শেষ ২০ ওভারের বোলিং ছিল দুর্দান্ত। বাংলাদেশের জয়ের পথে হাঁটা শুরু এই সময়েই।

বল হাতে মাশরাফি ছিলেন দুর্দান্ত। উইকেট পাননি, তবে ভাগ্যটাকে একটু পক্ষে পেলে পেতে পারতেন গোটা তিনেক উইকেট। একই কথা প্রযোজ্য সাকিব ও রুবেলের জন্য। বোলিং ফিগার বোঝাতে পারবে না, আসলে কতটা ভালো বোলিং করেছেন দুজন। তাসকিনকে যে আশায় ফেরানো হয়েছিল, সেটি তিনি পূরণ করেছেন দারুণভাবে। তিনিই ছিলেন বোলিংয়ের ‘এক্স ফ্যাক্টর’। শুরুর ব্রেক-থ্রু আর পরে রস টেইলরের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট এনে দিয়েছেন। শুরুটা হতাশার হলেও মুস্তাফিজ পরে পুষিয়ে দিয়েছেন অনেকটা।

ম্যাচের বেশিরভাগ জুড়ে মাশরাফির বোলিং পরিবর্তন আর মাঠ সাজনো ছিল প্রায় নিখুঁত। ৪১ ওভারের পরে মোসাদ্দেক হোসেনকে বোলিংয়ে এনে চমকে দিলেন সবাইকে। মোসাদ্দেক আরও বড় চমক দিলেন ইনিংসের ম্যাচের মোড় পাল্টে দেওয়া ৩ উইকেটে। আর মাঠে প্রাণবন্ত আর অনুপ্রেরণাদায়ী তো মাশরাফি বরাবরই।

ব্যাটিংয়ের শুরুটা অবশ্যই ছিল বিভীষিকা। তবে দিনটি যে বাংলাদেশের! জয়টিকে রূপকথা করে রাখতেই যেন চিত্রনাট্য হলো নাটকীয়। ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির পুনর্জন্মের নতুন ও রোমাঞ্চকর আখ্যান।

চ্যাম্পিয়নরা ঝিমিয়ে পড়লে নাড়া দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় উপলক্ষ। এদিনের মঞ্চ সাকিবের জেগে ওঠার জন্য ছিল আদর্শ। অসাধারণ ইনিংসটি বুঝিয়ে দিল কেন তিনি দলের সেরা ম্যাচ উইনার, কেন দেশের সবসময়ের সেরা, কেন এক ধাপ এগিয়ে। আগের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আম্পায়ারের বিস্ময়কর সিদ্ধান্তে ফিরতে হয়েছে। এ দিন কোনো ভুল করেননি, আম্পায়ারদের ভুলের সুযোগও দেননি।

মাহমুদউল্লাহ বরাবরই এক আলোকবর্তিকা। যখনই দলের ব্যাটিংয়ে আঁধার, তিনি পথ দেখান প্রায়ই। আড়াল থেকে আলোর উৎস হতেই ভালোবাসেন। তবে মাঝেমধ্যে তার আলোর ছটায় ধাঁধিয়ে যায় সবার চোখ। বিশ্বকাপে জোড়া সেঞ্চুরির পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির এই ইনিংস। নিজের সবচেয়ে সেরাটা জমা রাখেন যেন উপযুক্ত মঞ্চের জন্য।

গত শ্রীলঙ্কা সফরেই তাকে ওয়ানডে থেকে বাদ দেওয়ার আয়োজন হয়ে গিয়েছিল। সেটি সম্ভব হয়নি সংবাদমাধ্যমে কড়া সমালোচনা ও অধিনায়ক মাশরাফির জেদে।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যত পথচলায় এই জয় কাজ করবে মহৌষধের। বিরুদ্ধ কন্ডিশনে, সুইং বোলিং আর বাউন্সের চ্যালেঞ্জ সামলে, প্রচণ্ড চাপের থাবা সরিয়ে খাদের কিনারা থেকে জয় মানে এই দলের জন্য অসম্ভব কিছুই নয়!

কার্ডিফে প্রথম দিনের অনুশীলনেই কোচ চন্দিকা হাথুরিংহে দলকে বলেছিলেন, দেশের মাটিতে অনেক হয়েছে। এবার বিদেশের মাটিতে বড় দলগুলিকে হারাতে হবে। শুরুটা নিউ জিল্যান্ডকে দিয়ে কেন নয়? ব্যস, শুরু হয়ে গেল। র‌্যাঙ্কিংয়ের ঊর্ধ্ব পানে ছোটার পথে আরেকটি সোপান। সেমি-ফাইনালে উঠতে পারলে দারুণ, না পারলেও ক্ষতি নেই। ভবিষ্যতের পানে যাত্রা শুরু হয়ে গেছে!

জয়ের পর মাঠের ৬ হাজার দর্শকের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ চিৎকারে প্রকম্পিত ছিল চারপাশ। ম্যাচ শেষের অনেক পরেও স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। কার্ডিফ থেকে তা ছড়িয়ে পড়বে গোটা ক্রিকেট বিশ্বে। এই জয়ের মতোই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশে আরও অনেক জয়ের সুবাসে মোহিত হবে চারপাশ।

এই দলই পারবে। বুকের ভেতরে, আছে প্রত্যয়, স্বপ্ন পূরণ হবে নিশ্চয়!