বিশ্বাসের জয়, বাঁক বদলের জয়

“তিল ধারণের ঠাঁই নেই”, রূপক কথাটিও সেদিন যেন সত্যি হয়ে ফুটে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। উপলক্ষ্য বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে। ২০০৪ সালে, প্রতিপক্ষ ভারত। সেই জনসমুদ্র উচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে উত্তাল হয়েছিল বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ে। শুরু হয়েছিল নতুন এক অধ্যায়ের। শততম টেস্টের জয়েও সূচনা হতে পারে সাদা পোশাকে রঙিন অধ্যায়ের।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2017, 05:40 PM
Updated : 19 March 2017, 05:40 PM

শততম টেস্ট আর ওয়ানডেকে এক সুতোয় গাঁথা যায় জয়ের ফুল দিয়েই। তবে শুধু এটুকুই নয়। দুই ফুলের পাপড়িগুলোও একই রঙের! শততম ওয়ানডের জয়টি ছিল ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়। শততম টেস্টের জয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম।

ওয়ানডের সেই জয়ও এসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটে ভীষণ প্রয়োজনের সময়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, দেশের মাটিতে তখনও কোনো ওয়ানডে জিততে পারেনি বাংলাদেশ। একটি জয়ের জন্য ছিল চাতক পাখির প্রতীক্ষা। শততম ম্যাচে জয়ের বৃষ্টিতে ভেজার আকাঙ্ক্ষাতেই সেদিন গ্যালারিতে ছিল উপচে পড়া ভিড়।

এবার খেলা বিদেশের মাটিতে। সমর্থকদের ছোট্ট একটি দল ছাড়া বাংলাদেশের সমর্থনে উচ্চকিত নয় গ্যালারি। তবে জয়টা এবারও ছিল একই রকম আকাঙ্ক্ষিত। জয়ের আশা নিয়ে শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার পর প্রথম টেস্টের বাজে হার এসেছিল বড় ধাক্কা হয়ে। পাশাপাশি মাঠের বাইরের নানা বিতর্কে দল ছিল জেরবার। ড্রেসিং রুমের আবহ নিয়েও ছিল নানা গুঞ্জন। এই সব কিছুর সবচেয়ে বড় দাওয়াই ছিল জয়।

দুটি জয়ের আরেকটি বড় মিল হয়ে উঠতে পারে জয়ের সুবাস। সেবার ভারতকে হারিয়ে ওয়ানডেতে শুরু হয়েছিল নতুন পথচলা। শততম ম্যাচের আগে টেস্টের চেয়ে ওয়ানডের পরিসংখ্যান বাংলাদেশের জন্য ছিল আরও করুণ। ৯৯ ম্যাচে জয় ছিল স্রেফ ৫টি। বড় জয় বলতে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো। বাকি চার জয় কেনিয়া, স্কটল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে ও হংকংয়ের বিপক্ষে।

শততম ম্যাচে সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতকে হারানোর পরই বাংলাদেশ পায় সেই আত্মবিশ্বাস, যেটির নাম ‘আমরাও পারি’। সেই আত্মবিশ্বাসের ছোঁযাতেই বাংলাদেশ এগিয়ে যায় সামনে। কয়েক মাস পর হারায় অস্ট্রেলিয়াকে, পরের বছর শ্রীলঙ্কাকে। জিম্বাবুয়েকে হারানো শুরু করে নিয়মিত।

শততম টেস্টের জয়টিও বাংলাদেশের জন্য হতে পারে একই রকম টনিক। গত অক্টোবরে মিরপুর টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারানো সম্ভব হয়েছে বটে। তবে সেটি ছিল টার্নিং উইকেটে, নিজেদের পরিচিত আঙিনা আর আবহে। টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতির বার্তা ক্রিকেট বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিদেশের মাটিতে একটি জয় জরুরি ছিল। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিজেদের আত্মবিশ্বাসের জন্য।

দেশের মাটি বরাবরই শ্রীলঙ্কার দুর্গ। এই টেস্টের আগের দেশে টানা ৬ টেস্ট জিতেছে তারা। সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে পিছিয়ে পড়ে ফিরে আসা এবং মাঠের বাইরের সব বিতর্ককে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখানো, এই জয় হতে পারে অফুরন্ত আত্মবিশ্বাসের রসদ।

টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের ছাপ রাখার জন্য এই বছর বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেস্ট ম্যাচ বেশি খেলতে না পারা নিয়ে বরাবরের যে আক্ষেপ, এই বছর সেটিকে সত্য প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ। সব ঠিক থাকলে এবার ১১টি টেস্ট মাচ খেলার সুযোগ। যেগুলো ভালো করলেই কেবল আগের আক্ষেপগুলো যুক্তি খুঁজে পাবে। ক্রিকেট বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়া যাবে। আরও বেশি টেস্টের দাবি জোড়ালো কণ্ঠে তোলা যাবে।

বছরের আগের চার টেস্টে ছিল দুই রকমের হতাশা। ওয়েলিংটনে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে, হায়দরাবাদে ভারতের বিপক্ষে ছিল ড্রয়ের সুযোগ। পরিস্থিতি, পারিপাশ্বির্কতা ও বাস্তবতা বিবেচনায় ওই দুটি ড্র হতে পারত জয়ের সমান। শেষ পর্যন্ত পারেনি বাংলাদেশ। বাকি দুই টেস্টে বাজেভাবে হার। ক্রাইস্টাচার্চে হেরেছে চারদিনে, গলে আড়াইশরও বেশি রানে।

অনেক সময় বাজে হারের চেয়ে আত্মবিশ্বাসে বেশি চোট লাগে জয় বা ড্রয়ে সম্ভাবনা জাগিয়েও বারবার হারলে। সেই চোট সারিয়ে তোলার ওষুধও জয়। মানসিক বাধাগুলো দূর করা। কঠিন মুহূর্তগুলো পক্ষে আনা। একবার করতে পারলেই পথটা জানা হয়ে যায়। এরপর পথের শেষ পর্যন্ত সবসময় যেতে না পারলেও পথটা চেনাই থাকে।

কলম্বোর জয় আশা করা যায় সেই পথের সন্ধান বাংলাদেশকে দিয়েছে। পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রত্যাশিত দুটি সিরিজ যদি হয়, দেশের মাটিতে বাংলাদেশ থাকবে আরও আত্মবিশ্বাসী। অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে কন্ডিশন অবশ্যই শ্রীলঙ্কার মতো হবে না। তবে বিদেশে টেস্ট মানেই ভীতিকর কিছু, এই অনুভূতিটা অন্তত থাকবে না। আর ডরভয় থাকবে যত কম, নিজেদের সহজাত খেলা ফুটিয়ে তোলার সম্ভাবনা বাড়বে তত বেশি।

এই সবই প্রত্যাশার কথা। ভবিষ্যত তো সবসময় প্রত্যাশার সুরে কণ্ঠ মেলায় না। তবে শততম ওয়ানডের সেই জয়টাই আশার জাগায়, স্বপ্ন দেখায়। উপলক্ষ্য মাহাত্ম্যপূর্ণ হয় তখনই, যদি সেটিকে স্মরণীয় করে রাখা যায়। শততম ওয়ানডে না জিতলে কেউ হয়ত সেই ম্যাচ মনেই রাখত না। শততম টেস্টও তেমনি স্মরণীয় হয়ে থাকবে জয়ের কারণেই।

কে জানে, হয়ত আজ থেকে অনেক বছর পরে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে নিয়ে যখন আলোচনা হবে, ১৫০ বা ২০০তম টেস্টের সময় যখন পেছন ফিরে তাকানো হবে, হয়ত শততম টেস্টের জয়কেই মনে হবে বাংলাদেশের বাঁক বদলের মুহূর্ত!