সেই অ্যালট, এই অ্যালট

হাতের রিস্ট ব্যান্ড, গায়ের জার্সি খুলে রেখেছেন অনেক আগেই। কেতাদুরস্ত পোশাকে দিন কাটে প্রশাসকের ব্যস্ততায়। চেহারা ও শরীরে সময়ের ছাপ কিছুটা পড়েছে। তবু চিনে নিতে খুব একটা সমস্যা হয় না। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ যারা দেখেছেন, তারা হয়তো মানুষটিকে ভুলবেন না কখনোই। সেই টুর্নামেন্টের বিস্ময়, জেফ অ্যালট!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিক্রাইস্টচার্চ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2017, 10:36 AM
Updated : 21 Jan 2017, 01:32 PM

ব্যাংকার, ক্রিকেটার, প্রশাসক

নিউ জিল্যান্ড তো বটেই, সর্বকালের সেরা পেসারদের ছোট্ট তালিকায় থাকেন একজন। আরেকজন শুরু করেছিলেন অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু কলি থেকে ফুল হওয়ার পথেই ঝরে পড়েছেন চোটের ছোবলে। রিচার্ড হ্যাডলি ও জিওফ অ্যালট। হ্যাগলি ওভালের হ্যাডলি প্যাভিলিয়নে দুজনকে দেখা গেল কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছেন গভীর মনোযোগে। ক্রিকেট ইতিহাস দুজনকে অবশ্যই রাখবে দুই মেরুতে; তবে আপাতত পরিচয় একই। দুজনই নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের পরিচালক। আরেক সাবেক পেসার মার্টিন স্নেডেনের পাশাপাশি এই দুজনও বোর্ডের পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন ২০১৩ সালে।

অ্যালটের ক্রিকেট প্রশাসক পরিচয়টা অবশ্য পুরোনো। পরিচালক হওয়ার আগে ২০০৮ সালে দায়িত্ব নিয়েছিলেন নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে। নতুন ওই পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল তাকে ভেবেই। ক্রিকেট পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, কোচিং ও দল নির্বাচন, সবকিছু দেখভালের গুরুদায়িত্ব ছিল তার ওপর। ২০১০ সালে বাংলাদেশ নিউ জিল্যান্ডকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশ করার পর ব্যর্থতার দায় নিয়ে ছেড়েছিলেন পদ।

ক্রিকেটার ও প্রশাসকের বাইরে একসময় ছিল আরেকটা পরিচয়। ক্রিকেটার জীবনের শুরু ও শেষে ছিলেন ব্যাংকার! ১৯৯৬ সালে যখন পা রাখেন আন্তর্জাতিক আঙিনায়, তখনও পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা। ক্রিকেটে বেশি মনোযোগী হতে ১৯৯৮ সালে ছেড়ে দেন ব্যাংকের চাকরি। কিন্তু চোটের থাবায় দু বছর পর ছাড়তে হয় ক্রিকেটই। ফিরে যান কর্পোরেট জীবনে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি, পুরোনো পেশায় শুরু হয় নতুন জীবন। এখন আবার প্রশাসক হয়ে ক্রিকেটের সংস্পর্শে।

সোনালী অধ্যায়

নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটে অ্যালটের উত্থান নব্বই দশকের মাঝামাঝি। শুরুর দিকে ছিলেন ‘জেনুইন’ ফাস্ট বোলার। তেড়েফুঁড়ে এসে বল করতে চাইতেন, ব্যাটসম্যানকে উড়িয়ে দিতে চাইতেন একের পর এক বাউন্সারে। কিন্তু সেই চেষ্টায় বিপর্যন্ত হন নিজেই। চোট জানান দেয় নিজের অস্তিত্ব, কার্যকরও হচ্ছিলেন না খুব একটা। তাই গতি কমিয়ে মন দেন সুইংয়ে। সাফল্যও ধরা দেয় খুব দ্রুত। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্যান্টারবুরির হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আবির্ভাব, পরের ফেব্রুয়ারির আগেই পেয়ে যান টেস্ট ক্যাপ!

টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু। তবে সাদা পোশাকে সাফল্য মিলেছে সামান্য। বরং ব্ল্যাক ক্যাপদের কালো পোশাকে ছিলেন বেশি উজ্জ্বল। উজ্জ্বলতম অধ্যায় ১৯৯৯ বিশ্বকাপে।

সেবার ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন যখন, একাদশ জায়গা তখনও নড়বড়ে। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩ উইকেট। পরের ম্যাচে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর ম্যাচে উইকেট চারটি। নড়বড়ে জায়গা ততক্ষণে পোক্ত। বিস্ময় যাত্রার শুরু।

পাকিস্তানের বিপক্ষেও নিলেন ৪ উইকেট। স্কটল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিনটি করে। তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিলো দলও। ২০ উইকেট নিয়ে নতুন বিশ্বকাপ রেকর্ড গড়লেন সেমি-ফাইনালের আগেই। পর্দার আড়াল থেকে তিনিই তখন বিশ্বকাপের নায়ক।

তবে যথারীতি সেমি-ফাইনালে মুখ থুবড়ে পড়ল নিউ জিল্যান্ড। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে পাকিস্তানের বিপক্ষে হারের ম্যাচে উইকেটশূন্য অ্যালটও। পরে ফাইনালে ৪ উইকেট নিয়ে শেন ওয়ার্ন ছুঁয়েছিলেন তাকে। যৌথভাবে হন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।

শেষটা হতাশার হলেও পরে সেটিই হয়ে গেছে তার সবচেয়ে গর্বের অধ্যায়। ১৯৯৯ বিশ্বকাপই তার পরিচায়ক, বলা যায় অ্যালটের ক্যারিয়ারের প্রতিশব্দ। প্রায় দেড় যুগ পরেও সেই বিশ্বকাপকে মনে করে রোমাঞ্চের ছোঁয়া তার কণ্ঠে।

“আমার সহজাত প্রতিভা ততটা ছিল না, কষ্ট করে চেষ্টা করেছি। দেশের হয়ে খেলতে পারাই তাই ছিল বড় সম্মান। আর বিশ্বকাপে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা এবং শেন ওয়ার্নের মত একজনের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হওয়া সব দিক থেকেই ছিল স্বপ্নের মত।

“সেমি-ফাইনালে আগের ম্যাচগুলোর মত পারফর্ম করতে না পেরে তখন হতাশ হয়েছিলাম। তবে সব মিলিয়ে ওই বিশ্বকাপ অসাধারণ এক স্মৃতি, যা আমি হৃদয়ে লালন করি সযত্নে।”

ওই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের মুখোমুখি হয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। চেমসফোর্ডে যে ম্যাচটি দিয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিষেক। নিজের প্রথম দুই ওভারেই অ্যালট ফিরিয়েছিলেন বাংলাদেশে দুই ওপেনার শাহরিয়ার হোসেন ও মেহরাব হোসেনকে। পরে শেষ উইকেটটিও নিয়ে বাংলাদেশকে গুটিয়ে দিয়েছিলেন ১১৬ রানে। নিউ জিল্যান্ড জিতেছিল ৬ উইকেটে।

সেই ম্যাচের কথা মনে করে এতদিন পরে সহানুভূতিই ঝরল অ্যালটের কণ্ঠে।

“আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল যে টুর্নামেন্টের প্রথম দিকে বাংলাদেশকে পেয়েছিলাম। কন্ডিশন কঠিন ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য, বল বেশ সুইং করছিল। নবীন দলের জন্য বেশ কঠিন ছিল।”

“১৯৯৮ সালে আইসিসি নক আউট বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। সেই স্মৃতিও মনে আছে। অনেক দর্শক হয়েছিল মাঠে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুব ভালো না খেলেও রোমাঞ্চকর জয় পেয়েছিলাম আমরা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে গেলাম পরের ম্যাচে।”

সবচেয়ে ‘বড়’ শূন্য

১৯৯৯ বিশ্বকাপ ছাড়া আন্তর্জতিক ক্রিকেট অ্যালটকে মনে রাখবে আরেকটি পারফরম্যান্সকেও। তার একমাত্র বিশ্বরেকর্ড। তবে বল হাতে নয়, ব্যাটিংয়ে!

টেস্টে ১৫ ইনিংসে করেছেন ২৭ রান। সর্বোচ্চ ৮। তবে এর মধ্যেও একটি ইনিংসে সুযোগ পেয়েছিলেন ব্যাট উঁচিয়ে ধরার!

১৯৯৯ বিশ্বকাপের আগে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অকল্যান্ড টেস্ট। ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটে গিয়েছিলেন অ্যালট। ক্রিস হ্যারিসের সঙ্গে শেষ উইকেটে গড়েছিলেন ২৭ ওভারে ৩২ রানের জুটি। তাতে অ্যালটের অবদান ৭৭ বল ও ১০১ মিনিট খেলে শূন্য! বলের হিসাব বা মিনিট, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে ‘বড়’ শূন্যের রেকর্ড এটিই।

সবচেয়ে বেশি বল খেলেও রান না করার আগের রেকর্ড ভাঙার পর ব্যাট উঁছিয়ে ধরেছিলেন, যেন সেঞ্চুরি করেছেন!

“ওই ইনিংস নিশ্চয়ই ভুলে যাননি?” প্রশ্ন শেষের আগেই প্রায় মুখের কথা কেড়ে নিলেন অ্যালট, “আমার বন্ধুরা আমাকে খোঁচাতেই থাকে ওটা নিয়ে, কাজেই ভোলার উপায় নেই! আসলে ক্রিস হ্যারিস অন্তত পাঁচবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সিঙ্গেল নেয়নি। নইলে সহজেই কিছু করতে পারতাম। কিন্তু ক্রিস আমাকে বঞ্চিত করে স্বার্থপরের মতো নিজের অর্ধশতক করে নিল!”

“ক্যারিয়ারে ওই একবারই ব্যাট উঁচিয়ে ধরার সুযোগ পেয়েছিলাম। আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল, ওই ম্যাচেই ড্যারিল কালিনান ২৭৫ রান করেছিল। তো ইনিংসে শেষে স্কোরার এসে আমাকে দুটি ওয়াগন হুইল ধরিয়ে দিল। কালিনানের ওয়াগন হুইলে অবশ্যই পুরোটা জুড়ে ছিল দাগ, আমারটা একেবারে সাদা! এখনও আমি রেখে দিয়েছি দুটিই।”

চোট-জর্জর ক্যারিয়ার

“পিঠে সাত-সাতটি স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের ধাক্কা, চিন্তা করতে পারেন? চারবার লম্বা সময় মাঠের বাইরে থেকে ফিরতে হয়েছে। অনেক সময় লেগে গেছে একেকবার…”, এত বছর পর নিজের চোট জর্জর অতীতের কথা ভেবে হাসতে পারলেন অ্যালট।

মাশরাফি বিন মুর্তজার দুই হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচারের সঙ্গে তুলনীয় কিছু আর নেই। তবে অ্যালটের চোটের ইতিহাসও কম ভয়াবহ নয়। ফাস্ট বোলারদের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চোট ‘স্ট্রেস ফ্র্যাকচার’। একটি স্ট্রেস ফ্র্যাকচারই অনেক সময় ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অ্যালটকে সেই চোটের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে একের পর এক।

সবাই তো মাশরাফির মতো নয়; পিছু না ছাড়া চোটের সঙ্গে পেরে ওঠেননি অ্যালট। এক পর্যায়ে ক্ষান্তি দেন লড়াইয়ে। অমন সফল বিশ্বকাপ কাটিয়ে পরের ওয়ানডে খেলতে পেরেছিলেন দেড় বছর পর! বিশ্বকাপের পর সব মিলিয়ে খেলতে পেরেছিলেন আর মাত্র ৯টি ওয়ানডে। সবশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি যখন খেললেন, বয়স তখনও ২৯ পূর্ণ হয়নি!

প্রায় ৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। ১০টি টেস্টে ১৯ উইকেট ও ৩১ ওয়ানডেতে ৫২ উইকেট; আর অনেক অনেক দীর্ঘশ্বাস!

নতুন দিনের স্বপ্ন

ওখানেই শেষ হতে পারত অ্যালট অধ্যায়। চোটাক্রান্ত বিভীষিকার অতীত। কিন্তু ক্রিকেটার অ্যালটের দীর্ঘশ্বাসগুলোই প্রশাসক অ্যালটের শক্তি। চোটের সঙ্গে যুদ্ধ করে মাশরাফি যেমন নিজেই ছোটখাটো বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন, অ্যালটও তেমনি খুব ভালো বোঝেন চোট-আঘাতের ভেতর-বাহির। নিজের ক্যারিয়ার থেকে পাওয়া শিক্ষাই কাজে লাগাচ্ছেন প্রশাসক হিসেবে।

“অনেক অনেক শিখেছি নিজের জীবন থেকে। আমি যা বুঝেছি, অ্যাকশন নিখুঁত না হলে আপনি যত চেষ্টা করবেন, শরীরের ওপর তত ধকল যাবে। আমার ক্ষেত্রে কার্যকর হওয়ার জন্য প্রতিটি বলেই আমাকে শতভাগ দিতে হতো। বুদ্ধিমান বোলার হলে ৯৫ ভাগ দিয়েই দারুণ কার্যকর হওয়া যায়।”

“এখন আমাদের বোলাররা অনেক ভালো অ্যাথলেট। সিস্টেমটা ভালো করেছি আমরা, যাতে স্কিলফুল বোলার বেশি বেরিয়ে আসে। স্কিল বেশি থাকলে সব বলেই শতভাগ উজার না করেও কার্যকর হওয়া যায়।”

নব্বইয়ের দশকে কিউই পেসারদের প্রতিশব্দ ছিল চোট। ড্যানি মরিসন, ডিওন ন্যাশ, ক্রিস কেয়ার্নস, শেইন ও’কনর, ক্রিস ড্রাম, হিথ ডেভিস, সাইমন ডুল; সবার ক্যারিয়ারই চোটের কাছে আত্মসমর্পণের গল্প। এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে অনেকটাই। বদলে দিতে পেরেছেন অ্যালটরা।

ক্রিকেটার অ্যালটের স্বপ্নগুলো মিলিয়ে গেছে চোটের ঝড়ো হাওয়ায়। প্রশাসক অ্যালট এগিয়ে চলেছেন স্বপ্নাতুর চোখে, সাফল্য ছুঁয়ে আরও নতুন সাফল্যের পথে। ক্রিকেটার অ্যালট হার মেনেছিলেন চোটের কাছে। প্রশাসক অ্যালটের হাত ধরে রচিত হচ্ছে অনেকের চোট জয়ের গল্প!