‘কী রে, টেস্ট খেলবি…!’

মূল গ্যালারিতে টানা লম্বা কাঠের বসার আসন। পাশ দিয়েই একটা গলিপথ ধরে ড্রেসিং রুমের মুখ। গলির অন্ধকার থেকে ভেসে আসছিল একটি অবয়ব। এগিয়ে যেতেই ফুটে উঠল উদ্ভাসিত একটি মুখ। বেরিয়ে এলেন তাসকিন আহমেদ, মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনি ওয়েলিংটন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Jan 2017, 10:24 AM
Updated : 10 Jan 2017, 12:29 PM

অনুশীলনে গা গরমের সময় হাসছেন। নেটে বোলিং করার সময় কোচ-বোলিং কোচ কী কী সব বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি মনোযোগী হয়ে শুনছেন, আবার থেকে থেকেই হাসছেন। নেটে ব্যাটিং করে এলেন, হেলমেটের ফাঁক গলে আলো ছড়াচ্ছে হাসিমুখ। তাসকিনের মুখে শুধু হাসি আর হাসি।

তাসকিন হাসছেন। তাকে নিয়ে সতীর্থরাও হাসছে। বাংলাদেশের অনুশীলনে হাসির ফোয়ারা। সেই ফোয়ারার উৎস কোথায়? তাসকিন আবার হাসেন, “দলের সবাই এখন আমাকে দেখছে আর হাসছে, ‘কী রে, টেস্ট খেলবি!’ সবাই হেসে হেসে বলছে। আমারও ভালো লাগছে, কারণ স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। টিমমেটরা সবাই উৎসাহ দিচ্ছে। কোচরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন। সবাই অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।”

হ্যাঁ, তাসকিনের হাসি স্বপ্ন সত্যি হতে চলার হাসি। যে গলিপথ ধরে বেরিয়ে এলেন, সেটি আসলে স্বপ্ন পূরণের করিডোর। ছোঁয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা!

তাকে টেস্ট স্কোয়াডে রাখা হয়েছে খেলানোর জন্যই। সবুজ ২২ গজের মঞ্চ প্রস্তুত। বৃহস্পতিবার বেসিন রিজার্ভে তাসকিনের মাথায় উঠছে টেস্ট ক্যাপ। ২১ বছর বয়সী ফাস্ট বোলার ডুবে আছেন রোমাঞ্চে।

“সত্যি কথা বলতে, টেস্ট অভিষেক হলে সেটি হবে স্বপ্ন পূরণের মত। গত আড়াই বছরে যত আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেছি, সবসময় দেখা যেত টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডে সিরিজ শেষ হলে আমি চলে যেতাম। এবার থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। সুযোগ পেলে নিজের সেরাটা দেব। আমার স্বপ্ন পূরণ হবে খেলতে পারলে।”

২৩ ওয়ানডে ও ১৪ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। তবে টেস্ট দলের একজন হয়ে টেস্টের অনুশীলনে এটিই ছিল তার প্রথম দিন। সতীর্থরা যে তার সঙ্গে খুনসুটি করছেন, টিপ্পনি কাটছেন, সেটিও এই কারণেই। তাসকিনের স্বপ্ন দোলা দিয়েছে সতীর্থদের। আরেকটু ছড়িয়ে বললে, বাংলাদেশের ক্রিকেটকেই!

সেই বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই সম্ভাবনা দেখে তাসকিনের মাঝে বিনিয়োগ করছে বিসিবি। তার শারীরিক গঠন, তার সহজাত গতি ও আগ্রাসন, তার প্রতিভা, সবকিছুই সাহস জুগিয়েছে বিনিয়োগ করতে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর আগেই বড় একটা স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের ধাক্কা কাটিয়ে এসেছেন। লম্বা সময় ধরে সময় নিয়ে তাকে ফিট করে তোলা হয়েছে। শক্তপোক্ত করা হয়েছে। গতি বাড়ানো হয়েছে। নিবিড়ভাবে কাজ করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে আজকের মঞ্চের জন্য।

প্রক্রিয়াটা পেরিয়ে এসেছেন বলেই তাসকিন জানেন কত সাধনার ফসল তিনি। কণ্ঠে থাকল সেই কৃতজ্ঞতাও।

“টেস্টে সুযোগ পাওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। বিসিবি থেকে, দলের সাপোর্ট স্টাফ অনেক সাহায্য করেছেন সবাই। আমার জন্য আলাদা প্রোগাম তৈরি করা হয়েছিল, সেই প্রোগ্রাম অনুযায়ী ট্রেনিং করেছি। গত দেড়-দু বছরে আস্তে আস্তে বোলিং ওয়ার্ক লোড বাড়িয়েছি। প্রস্তুত বলেই এখন খেলতে যাচ্ছি।”

রোমাঞ্চের শিহরণের পাশাপাশি সংশয়ের চোরকাঁটাও আছে। প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ১০টি। শেষটি সেই ২০১৩ সালে। মাত্র কয়েক মাস আগেই কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, এখনই টেস্টে নামিয়ে তাসকিনের ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে চান না। তো টেস্টের দাবিটা মেটাতে পারবেন তো তাসকিন? তার নিজের অবশ্য কোনো সংশয়ই নেই।

“নেটে এমনও দিন হয়েছে যে কয়েকটা স্পেলে ১২-১৫ ওভার বোলিং করেছি। নতুন বলে, পুরোনো বলে। আরও কিছু কিছু কাজ করছি। লাল বলে সুইং করানো চেষ্টা করছি, শিখছি। ফিটনেসের অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো বলেই টেস্ট খেলতে যাচ্ছি। এক ম্যাচ খেলেই থেমে যেতে চাই না। নিয়মিত খেলতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, টেস্ট খেলতে খেলতেই আমি আরও শক্তপোক্ত হব।”

তাসকিনের স্বপ্ন আর বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বপ্ন এখানে মিলে গেছে এক বিন্দুতে- গতিময় আগ্রাসী এক ফাস্ট বোলার সাদা পোশাকে আগুন ঝরাচ্ছে লাল বলে। কেটে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কত শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত! এবার অপেক্ষা ফুরোনোর পালা।