‘এ দলে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে বাংলাদেশকে’

নিউ জিল্যান্ডের মিডিয়াম পেস বোলিং অলরাউন্ডারের তারা ভরা আকাশে তিনিও উজ্জ্বল একজন। টেস্ট অভিষেক ছিল সাড়া জাগানো। তবে রেকর্ড খুব খারাপ না হলেও সাদা পোশাকে ক্যারিয়ার খুব বড় হয়নি। ওয়ানডে ক্যারিয়ার এক যুগের, ছিলেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপে ছিল দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। খেলা ছাড়ার পর এখন ধারাভাষ্যকার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে স্কট স্টাইরাস কথা বললেন তার ক্যারিয়ার, চলতি সিরিজ ও বাংলাদেশ দল নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনি ওয়েলিংটন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Jan 2017, 01:52 PM
Updated : 9 Jan 2017, 01:54 PM

ক্রিকেট খেলা মিস করেন?

স্কট স্টাইরাস: একদমই না! একদিনের জন্যও একটু না! জীবনে আর কখনও ব্যাট-বল হাতে না নিলেও খুশি থাকব। কারণ ছাড়ার সময়ই আমার মনে হয়েছিল যথেষ্ট হয়েছে। ২০ বছর খেলেছি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, ১২ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। বেশিরভাগ ক্রিকেটারই জানে সময়টা কখন শেষ, এরপর আর খেলতে চায় না। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটিই।

কিন্তু ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় কখনোই মনে হয় না, মাঠে নেমে পড়ি আবার?

স্টাইরাস: ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় হয়েছে কিছুটা। ছেলেদের প্রতি ঈর্ষা হয়েছে আমার। কারণ দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ, দল অসাধারণ খেলছে, এই রোমাঞ্চে অংশ হতে পারাটা হতো দারুণ কিছু। এর বাইরে কখনোই মনে হয়নি। দুবাইয়ে মাস্টার্স খেলেছি, স্রেফ মজার জন্য। আর কিছু না। সত্যি বলতে এখন আর মজার জন্যও খেলতে ইচ্ছে করে না। ধারাভাষ্য কক্ষে বসে দারুণ সব ক্রিকেটারদের দেখি, তাদের নিয়ে বলি, এসবই ভালো লাগে।

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিলেন। সেমি-ফাইনালে ছোট একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছিলেন। ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত কি সেটিই?

স্টাইরাস: সেটিই এখনও পর্যন্ত নিউ জিল্যান্ডের একমাত্র বৈশ্বিক শিরোপা। অবশ্যই স্পেশাল। তবে আমার কাছে যে কোনো টুর্নামেন্ট, যে কোনো ম্যাচ জয়ই ছিল বিশেষ কিছু। সতীর্থদের সঙ্গে পরিশ্রম, অনেক লড়াইয়ের পর প্রতিটি জয় উদযাপনই ছিল দারুণ ব্যাপার।

টেস্ট অভিষেকটা একটু দেরিতে হয়েছিল আপনার। কিন্তু শুরুটা ছিল দারুণ। অভিষেকে সেঞ্চুরি ও অর্ধশতক। দেরিই তবে ভালো ছিল!

স্টাইরাস:
তা নয়। আগে হলেও নিশ্চয়ই ভালো লাগত। তবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। আগের বছরই আমার অভিষেকের কথা ছিল পাকিস্তানে। আমরা মাঠে যাওয়ার জন্য হোটেল ছাড়ছিলাম প্রায়। হোটেলের সামনে বোমা বিস্ফোরণ হলো। সিরিজ বাতিল হলো। অভিষেক হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরি ও অপরাজিত ৬৯, ব্রায়ান লারার উইকেট, এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারতাম না। স্বপ্নের মত পারফরম্যান্স ছিল।

তবে ততদিনে বছর তিনেক ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ফেলেছি। স্নায়ুর চাপ বা উত্তেজনা ততটা ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আবহ অনেকটাই জানা ছিল।

লারা প্রথম টেস্ট উইকেটে, প্রথম ওয়ানডে উইকেট ছিল শচিন টেন্ডুলকার…

স্টাইরাস: একটা সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম, আমার উচিত ছিল অভিষেকের পরই অবসর নেওয়া! আমি সৌভাগ্যবান। টেন্ডুলকার সেদিন দারুণ মারছিল। সেট হওয়ার পর লারাকে আউট করা সবচেয়ে কঠিন কাজগুলির একটি। সেটিও পেরেছিলাম।

মুত্তিয়া মুরালিধরনকে আপনি বেশ ভালোভাবে সামলেছেন। এত এত গ্রেট ব্যাটসম্যানরাও ওকে খেলতে হিমশিম খেয়েছে। আপনার সাফল্যের রহস্য কি ছিল?

স্টাইরাস: মুরালি আমাকে সবচেয়ে বেশিবার আউটও করেছে। ও এমন ভালো বোলার, যে কাউকেই যে কোনো সময় আউট করবে। আমার যেটা ছিল, আমি ওকে হাত থেকে অনেকটা পড়তে পারতাম। তবে এটা খুব বড় কিছু না। আমাদের দলেই এমন অনেক ব্যাটসম্যান ছিল যারা এমন সব বোলারকে অনায়াসে খেলেছে, আমার যাদের খেলতে সমস্যা হয়েছে। সাকলায়েন মুশতাক, পরে সাইদ আজমলকে পড়তে আমার সমস্যা হয়েছে। মুরালিকে তুলনায় সহজ মনে হয়েছে। আমাদেরই অন্যরা আবার আজমলকে সহজে খেলেছে, মুরালিকে পারেনি।

সুনিল নারাইনের বোলিং খেলতে পারলে আমার দারুণ লাগত। কখনও খেলিনি। অনেকেই আমাকে বলেছে, ওকে পড়া অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন। এই ধরনের রহস্য বোলারদের খেলা, তাদের পড়তে লড়াই করা এবং উপায় বের করা, এসব আমার কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর মনে হতো।

মুরালিকে আপনি অনেক স্লগ করেছেন…!

স্টাইরাস: এটা ছাড়া উপায় নেই। মুরালির বিপক্ষে সাফল্যের মূল উপায়ই হলো ওকে থিতু হতে না দেওয়া। সিঙ্গেল নিয়ে প্রান্ত বদল করা জরুরি, যেন সে কোনো ব্যাটসম্যানকে পেয়ে না বসে। আর সুযোগ পেলেই চার-ছক্কা মারা, যেটা আমি চেষ্টা করেছি, ওকে এলোমেলো করে দিতে। চাপটা ওকে ফিরিয়ে দিতে পারলে খেলা অনেকটা সহজ হয়ে যেত।

আপনার মুখোমুখি হওয়া সেরা বোলার কে?

স্টাইরাস: হয়ত চমকে যেতে পারেন, কত কত গ্রেট বোলারই ছিল। তবে আমার সবচেয়ে সমস্যা হয়েছে স্টিভ হার্মিসনকে খেলতে। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতা, খুব কাছ থেকে বুক সমান বাউন্স করাতে পারত, দারুণ গতিময় ও আগ্রাসী। ২০০৪ সালে আমরা ইংল্যান্ডে গিয়েছিলাম, পরের বছর ওরা অ্যাশেজ জিতল। এই দুই-তিন বছর হার্মিসন ছিল অবিশ্বাস্য।

ডেল স্টেইনও দারুণ। গ্লেন ম্যাকগ্রা, শেন ওয়ার্ন, মুরালি, সাকলায়েন…তালিকা লম্বা হতেই থাকবে। এই সময়ে দারুণ ব্যাপার এটাই ছিল যে এত এত গ্রেট বোলার ছিল। চ্যালেঞ্জটা কঠিন ছিল বলেই ছিল উপভোগ্য।

বোলিং করা সেরা ব্যাটসম্যান?

স্টাইরাস: রিকি পন্টিং। চোখ বন্ধ করে আমার বোলিং করা সেরা ব্যাটসম্যান। এরপর ব্রায়ান লারা, তার পর টেন্ডুলকার। তিন জনই অসাধারণ। তবে আমি পন্টিংয়ের সেরা সময়টায় বোলিং করেছি। সেই সময়ে সে ছিল অবিশ্বাস্য। শুরু থেকেই আগ্রাসী খেলে বোলারদের কাজ কঠিন করে তুলত। টেন্ডুলকারের ব্যাপার ছিল, সে ভুল খুব কম করত। সুযোগই দিত না বলতে গেলে। পন্টিং হয়ত সুযোগ দেবে। কিন্তু শুরু থেকে দারুণ সব শট খেলে বোলারদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। আরেকটা ব্যাপার, পন্টিং সবসময় চাপের মধ্যে এবং বড় ম্যাচে রান পেয়েছে। তিন জনের তুলনা করতে গেলে হয়ত ফেরারি, লাম্বরগিনি আর বেন্টলি গাড়ির মত হবে, একেকজনের পছন্দ একেকটা। আমার সেরা পন্টিং।

স্টিভেন ফ্লেমিংয়ের নেতৃত্বে খেলেছেন, ড্যানিয়েল ভেটোরিরও। এগিয়ে রাখবেন কাকে?

স্টাইরাস: দুজনই দারুণ। তবে স্টিভেন তো সবসময়েরই সেরা অধিনায়কদের একজন। আইপিএলে ওর কোচিংয়েও খেলেছি আমি। সে এক কথায় অসাধারণ। ভেটোরির কাজটা একটু কঠিন ছিল। দলটা গোছাতে হয়েছে। অনেকটাই পেরেছে সে। তবে স্টিভেন যেভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রেখে ম্যাচ নিজের দিকে নিয়ে আসত, সেটা ছিল একটা শিল্প।

এই সিরিজে আসা যাক, বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন কিভাবে করবেন?

স্টাইরাস: সত্যি বলতে, খুব খারাপ নয়! কারণ আমি মনে করি বাংলাদেশ এই সিরিজে অনেকগুলো সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছে!

আপনি তো বাংলাদেশের কোচ-অধিনায়ক-ক্রিকেটারদের সুরেই কথা বলছেন!

স্টাইরাস:
সেটিই তো বলা উচিত। উপমহাদেশের একটি দলের জন্য এখানে এসে প্রতি ম্যাচেই সুযোগ সৃষ্টি করা সহজ নয়। হ্যাঁ, সুযোগ পেয়েও কাজে না লাগাতে পারায় প্রশ্ন তুলতেই পারেন। সেখানেই ভালো দল এবং খুব ভালো দলের পার্থক্য। খুব ভালো দল ন্যূনতম সুযোগও লুফে নেয়। বাংলাদেশ অনেক কিছুই খুব ভালো করেছে। কিন্তু যখন ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণের সময়, ওই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতেই খেই হারিয়েছে। ওদেরকে এখন এটিই শিখতে হবে।

কিন্তু দেশে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে অনেক প্রত্যাশা যে ঘরের মাটির সাফল্য বাইরেও বয়ে নেবে দল!

স্টাইরাস: সমর্থকদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশে খেলে এখানে এসে ভালো করা খুব কঠিন। যেমন আমাদের জন্য কঠিন ওখানে গিয়ে ভালো খেলা! বাংলাদেশে এই দুদলের সিরিজ হলে বাংলাদেশই ফেবারিট থাকবে! ওখানে টানা সাতটি ওয়ানডে হেরেছি আমরা।

টাটকা উদাহরণ দেই, বিশ্বের শীর্ষ টেস্ট দল হিসেবে কদিন আগে নিউ জিল্যান্ডে এসেছিল পাকিস্তান। টানা সাত সিরিজে হারেনি। অথচ এখানে হোয়াইটওয়াশড হয়ে ফিরে গেছে। এখানকার বাউন্সে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মানিয়ে নেওয়া কঠিন। আরেকটা ব্যাপার, আমাদের বোলারদের তুলনায় বাংলাদেশের বোলাররা একটু খাটো। আমাদের বোলাররা বাউন্স বেশি পায়।

বাংলাদেশের তাই ভেঙে পড়ার কারণ নেই। আমি জানি ওরা সিরিজ জিততে চেয়েছিল। অন্তত একটি করে ম্যাচ। এবং সত্যি বলতে, জেতা উচিতও ছিল। কিন্তু আবারও বলছি, কাজটা কঠিন। এজন্যই বিসিবির উচিত ‘এ’ দলের পেছনে প্রচুর বিনিয়োগ করা। অর্থ খরচ করে হলেও ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়মিত দল পাঠানো। তাতে ব্যাটসম্যানরা যেমন, তেমনি ফাস্ট বোলাররাও মানিয়ে নিতে শিখবে। দেশের মাটির কন্ডিশনে বাংলাদেশ এখন দারুণ দল। এবার যদি বিদেশের জন্য পরিকল্পনা ঠিকমত নিতে পারে, বাংলাদেশও একদিন রাজত্ব করবে।

টেস্ট সিরিজ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জন্য আরও কঠিন হবে?

স্টাইরাস: অবশ্যই। জয়ের কথা ভাবলে বাংলাদেশের সুযোগ ছিল সাদা বলেই। টেস্টে উইকেট অনেক বেশি সিম ও বাউন্স করবে। ব্যাটসম্যানদের জন্য হবে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

তবে বাংলাদেশ চাইলে ইতিবাচকভাবে নিতে পারে। বোলারদের জন্য এটি দারুণ সুযোগ। আই লাইক দ্য লুক অব তাসকিন। ওর উচ্চতা ও শারীরিক গঠন, যে রকম বাউন্স পায়, তাতে অনেকটাই নিউ জিল্যান্ড ঘরানার ফাস্ট বোলার। ওকে অবশ্যই খেলাতে হবে। ওয়ানডেতে উইলিয়ামসনের মত ব্যাটসম্যানকে দুবার আউট করেছে। বাংলাদেশের জন্য সেই হবে মূল অস্ত্র। আমি নিশ্চিতভাবে জানি, কিউই ব্যাটসম্যানদের ভোগাবে সে।

উইলিয়ামসনের কথা যখন এলোই, সময়ের সেরা একজন হিসেবে তার বিকশিত হয়ে ওঠা দেশের সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে কেমন লাগে?

স্টাইরাস: আমি ওর সঙ্গে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছি। অনেক আগে থেকেই জানি সে কতটা ভালো। সে অবশ্যই নিউ জিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা হিসেবে শেষ করবে। আমি আশা করব, সব মিলিয়ে ও সবসময়র অন্যতম সেরা হয়ে উঠবে। সেই সামর্থ্য তার আছে।

নিউ জিল্যান্ডের একজন হিসেবে অবশ্যই ভালো লাগে যে বিরাট কোহলি, স্টিভেন স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ডেভিড ওয়ার্নার, জো রুটদের পাশাপাশি সময়ের অন্যতম সেরা একজন আমাদেরই। এই ব্যাটসম্যানদের একটা বড় ব্যাপার হলো, পরিস্থিতি-পারিপার্শ্বিকতা যেমনই হোক, এদের কেউ কখনও চাপে আছে বলে মনে হবে না। এটিই গ্রেটনেসের লক্ষণ। কেনও গ্রেট হবেই।